agribarta

ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যেদিকে চোখ যায়, কেবল তরমুজ আর তরমুজ


কৃষি

প্রথম আলো থেকে

(২ সপ্তাহ আগে) ৫ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৮:১৭ অপরাহ্ন

agribarta

মাঠের পর মাঠ, যেদিকে চোখ যায় কেবল তরমুজের সবুজ খেত। সেই খেতে ধরেছে সবুজ তরমুজ। কিছুদিনের মধ্যেই সুস্বাদু তরমুজ চলে যাবে খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। গত চার বছর আগেও এ জমিগুলো আমন ধান চাষের পর অনাবাদি পড়ে থাকত। শুষ্ক মৌসুমে মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যেত। তাই বৃথা পরিশ্রম হবে ভেবে কেউ চাষাবাদের চেষ্টাও করতেন না। এখন সেই জমিগুলোই স্বপ্ন দেখাচ্ছে খুলনার কয়রা উপজেলার চাষিদের। অল্প সময়ে বিনিয়োগের দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ লাভ করায় দিন দিন এখানকার কৃষকের ভরসা হয়ে উঠছে সুস্বাদু তরমুজ।

কয়রা উপজেলার আমাদী, চণ্ডীপুর, খিরোল, হরিনগর, কিনুকাটি গ্রামসহ অন্তত ১০টি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, সব গ্রামের বিলেই সবুজ আলপনা আঁকা বাহারি পাতার লতানো তরমুজগাছ। এরই মধ্যে ফলন এসেছে অধিকাংশ গাছে। কিছু গাছ থেকে তরমুজ তোলা সবে শুরু হয়েছে। এখনো ভরমৌসুম শুরু হয়নি। আগামী এক মাসের মধ্যে পুরোদমে শুরু হবে তরমুজ তোলা ও বিক্রয়ের কাজ।

কৃষকেরা তরমুজ খেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত। কেউ খেতে সেচ দিচ্ছেন, কেউ সার দিচ্ছেন, আবার কেউবা খেত থেকে তরমুজ তুলছেন। এভাবেই চলছে তরমুজ খেতের কর্মযজ্ঞ। অনেকে তরমুজ খেত পাহারা দিতে খেতের মধ্যে থাকার জন্য ছোট ছোট ঘর করেছেন। সেখানে আবার সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করেছেন তাঁরা।

উপজেলার আমাদী গ্রামের তরুণ কৃষক তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘তরমুজের টাকা দিয়েই এলাকার মানুষের ভাগ্য ফিরেছে। অথচ চার বছর আগেও এ রকম সময় অধিকাংশ জমি অনাবাদি পড়ে থাকত। এসব নোনা মাটির পতিত জমিতে তরমুজ চাষ করে কম খরচে অনেক ফলন পাচ্ছি।’

আমাদী বিলের কৃষক মোশাররফ মল্লিক এ বছর পাঁচ বিঘা জমিতে পাকিজা জাতের তরমুজ চাষ করেছেন। আগামী ১০ দিনের মধ্যে খেত থেকে পুরোদমে ফলন তোলা হবে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ভালো ফলন পাবেন বলেও প্রত্যাশা তাঁর। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। গত বছরও পাঁচ বিঘা জমির তরমুজ বিক্রি করে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। এবার যেভাবে ফলন হয়েছে, তাতে পাঁচ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

চণ্ডীপুর গ্রামের জুবায়ের রহমান গত বছর ৩০ বিঘা জমির তরমুজ বিক্রি করে ১৬ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। এ বছর আবাদের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০ বিঘাতে ঠেকেছে। তিনি বলেন, দাম থাকলে তরমুজে ব্যাপক লাভ। এবার মানুষ তরমুজের পেছনে উঠেপড়ে লেগেছে। কোথাও কোনো জমি ফাঁকা থাকছে না। ফলনও ভালো হয়েছে।


উপজেলা কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে কয়রা উপজেলায় মাত্র ৬৫ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছিল। উৎপাদন হয়েছিল ২ হাজার ৪৭০ মেট্রিক টন। পরের বছর দশ গুণ বেশি হয়ে ৬৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়। উৎপাদন হয়েছিল ২৯ হাজার ২৪৯ মেট্রিক টন। ওই বছর চাষি ভালো দাম পাওয়ায় ২০২২ সালে উপজেলায় তরমুজ আবাদের জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯৫ হেক্টরে। উৎপাদন হয়েছিল ৩১ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন। এরপর ২০২৩ সালে উপজেলায় তরমুজ আবাদের জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২০০ হেক্টরে। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ৪৪ হাজার ৫২৮ মেট্রিক টন। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে চলতি বছর সবচেয়ে বেশি জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন কৃষকেরা। এ বছর উপজেলায় তরমুজ আবাদের জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯৩০ হেক্টরে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৯৬০ মেট্রিক টন।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়রায় মূলত আমননির্ভর কৃষিব্যবস্থা চালু ছিল। লবণাক্ততা ও পানিসংকটের কারণে এখানকার কৃষক বোরো চাষে খুব একটা আগ্রহী হন না। আমন ধানের বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তুলতে পাঁচ মাস সময় লাগে। অন্যদিকে তরমুজে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত সময় লাগে সর্বোচ্চ আড়াই মাস। আর আমনে প্রতি বিঘায় খরচ বাদে লাভ হয় সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা। অন্যদিকে তরমুজে প্রতি বিঘায় খরচ হয় ২৪-২৬ হাজার টাকা। তরমুজ বিক্রি হয় ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের খুলনা কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হারুনর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়রার অধিকাংশ জমির লবণাক্ততার মাত্রা বেশি। ফলে শুধু আমন ধান ছাড়া কোনো ফসল হতো না। ২০১৫ সালের দিকে প্রথমবারের মতো কয়রার লবণাক্ত পতিত জমিতে ফসল উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে মাঠে নামি আমরা। ২০১৭ সাল থেকে সফলতা আসতে শুরু করে। গত তিন বছরে কয়রা উপজেলার লবণাক্ত জমিতে তরমুজ উৎপাদন ব্যাপক হারে বেড়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য এলাকার কৃষকেরা তরমুজ দ্রুত বড় করতে পিজিআর নামে একধরনের হরমোনের ব্যবহার করে। কিন্তু কয়রার কৃষকেরা এটা ব্যবহার করে না, এ কারণে এখনো কয়রার তরমুজগুলো বেশি সুস্বাদু ও নিরাপদ।’

কয়রা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, কয়রার নদীগুলোতে লবণপানি। আর সময়মতো খালে বাঁধ না দেওয়ায় সেই লবণপানি খালেও ঢুকে পড়ে। তরমুজের শেষ সময়ে সেচ–সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। তারপরও চলতি মৌসুমে তরমুজের আবাদ ও ফলন দুটিই বেড়েছে। কয়রার তরমুজ খুব মিষ্টি, বাজারে চাহিদাও ব্যাপক। গতবার কৃষকেরা তরমুজে ব্যাপক লাভ করেছিলেন। এবার কয়রার অনেক এক ফসলি বিলে প্রথমবারের মতো তরমুজ আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া শেষ পর্যন্ত অনুকূলে থাকলে উৎপাদনও অনেক ভালো হবে।