
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের শান্ত-স্নিগ্ধ গ্রাম লালমনিরহাট। প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা বেশিরভাগই কৃষিনির্ভর। চারপাশে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত, পুকুর-খাল-বিলের স্নিগ্ধ পরিবেশ আর মেঠোপথের সরল সৌন্দর্য এখানকার বৈশিষ্ট্য। এমনই একটি গ্রামে বেড়ে উঠেছেন উম্মে কুলসুম পপি, যার শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে গ্রামের মাটির সোঁদা গন্ধে মিশে। এই পরিবেশেই তৈরি হয়েছে তার মাটি ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা।
পপির শৈশব কেটেছে কৃষির কাছাকাছি। বাবা-মায়ের সাথে ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজে হাতেখড়ি হয়েছিল তার। গ্রামের খালবিল, পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে মাছ ধরা কিংবা মেঠোপথ ধরে হেঁটে যাওয়ার অভ্যাস তার মনোজগতে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল। ধানক্ষেতের সরু আইল ধরে হাঁটা, পুকুরপাড়ে বসে মাছ ধরার গল্প, কিংবা কৃষকদের কঠোর পরিশ্রম দেখে বেড়ে ওঠা — সবকিছুই তার মনে কৃষির প্রতি গভীর ভালোবাসা গড়ে তোলে।
কিন্তু এই ভালোবাসা শুধু আবেগে থেমে থাকেনি। শিক্ষাজীবনে এগিয়ে যাওয়ার পরেও পপি কৃষিকে কখনো ভুলে যাননি। বরং কৃষিকেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেন এবং সেই লক্ষ্যেই নিজেকে তৈরি করতে থাকেন।
উচ্চশিক্ষার জন্য পপি ভর্তি হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে পড়াশোনা করেছেন ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিষয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তার পরিচয় হয় আবু সাঈদ আল সাগরের সঙ্গে, যিনি ছিলেন পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র। সাগর ও তার কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘ক্রিয়েটিভ সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন, যেখানে গ্রাফিক্স ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং এবং উপস্থাপনা শেখানো হতো। পপি সেখানে যোগ দেন এবং ধীরে ধীরে প্রযুক্তি ও ভিডিও কনটেন্ট তৈরিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন।
পপি ও সাগর একসঙ্গে কাজ করতে করতে নিজেদের ভাবনা ও স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। তারা বুঝতে পারেন, দেশের তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে নতুন কিছু করতে হবে। তাদের সেই ভাবনা থেকেই ২০১৬ সালে ‘ক্রিয়েটিভ সোসাইটি’ রূপ নেয় ‘বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট লিমিটেড’ নামে একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগে।
প্রথম দিকে ‘বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট’ কাজ করত টেকনিক্যাল হোম সার্ভিস নিয়ে। পপি ও সাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ড্রপআউট শিক্ষার্থী এবং এসএসসি-এইচএসসিতে অকৃতকার্য ১৫-২০ জনকে নিজেদের টিমে যুক্ত করেন। তারা এ শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ টেকনিশিয়ান হিসেবে গড়ে তোলেন। এরপর ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে গ্রাহকদের বাসায় গিয়ে বিভিন্ন ধরনের টেকনিক্যাল সার্ভিস দেওয়া শুরু করেন। শুরুটা ছিল ছোট পরিসরে, কিন্তু লক্ষ্য ছিল বড়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিযোগিতায় ‘বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট’ তাদের অভিনব বিজনেস আইডিয়ার জন্য পুরস্কার জিতে নেয়। সেই পুরস্কার পাওয়ার সুবাদে সাগরের মুম্বাই যাওয়ার সুযোগ হয়। যদিও পপি তখন যেতে পারেননি, কিন্তু তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এটি ছিল বড় অর্জন।
এরপর পপি ও সাগর বুঝতে পারেন, তাদের দুজনের স্বপ্ন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনেকটাই মিল রয়েছে। সেই ভাবনা থেকেই তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং একসঙ্গে নতুন উদ্যোগের চিন্তা শুরু করেন।
২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারিতে পপি ও সাগরের সেই উদ্যোগ ‘বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট’ বড় ধাক্কা খায়। টেকনিক্যাল হোম সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়, কর্মীরাও অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হন। সঙ্কটের মুখে পড়েও হাল ছাড়েননি পপি। বরং এসময় মাথায় আসে নতুন একটি আইডিয়া — অনলাইনে মৌসুমি ফল বিক্রির পরিকল্পনা।
রংপুরের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙা আমকে কেন্দ্র করে ‘প্রিমিয়াম ফ্রুটস’ নামে একটি উদ্যোগ শুরু করেন তারা। চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি আম সংগ্রহ করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ শুরু করেন। এতে একদিকে যেমন স্থানীয় কৃষকরা উপকৃত হন, অন্যদিকে ভোক্তারাও নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম পেতে শুরু করেন।
এরপর শুধু হাঁড়িভাঙা আম নয়, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের আম, মৌসুমি ফল, এমনকি বিষমুক্ত সবজিও সরবরাহ করতে শুরু করেন তারা। ‘প্রিমিয়াম ফ্রুটস’ পরিণত হয় একটি সফল উদ্যোগে।
পপি কৃষির প্রতি ভালোবাসা এবং প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহকে একসঙ্গে কাজে লাগান। ২০১৮ সালে তিনি চালু করেন নিজের ইউটিউব চ্যানেল, যেখানে কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন টিপস, চাষাবাদের কৌশল, জৈব সার ব্যবহার, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি এবং কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার পথনির্দেশনা নিয়ে ভিডিও তৈরি করেন।
প্রথম দিকে তার ভিডিওগুলো খুব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। কিন্তু পপির উপস্থাপনা দক্ষতা, তথ্যপূর্ণ ভিডিও কনটেন্ট এবং সহজবোধ্য ব্যাখ্যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তার ভিডিওগুলোতে শুধু কৃষি বিষয়ক তথ্য নয়, বরং কৃষিকে নতুন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে নানা উদ্ভাবনী ধারণাও তুলে ধরেন তিনি।
এভাবেই পপি বাংলাদেশের প্রথম নারী ‘অ্যাগ্রো ইনফ্লুয়েন্সার’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার তৈরি ভিডিওগুলো শুধু নতুন কৃষকদের জন্য নয়, বরং অভিজ্ঞ কৃষকদের জন্যও দারুণ সহায়ক।
পপি শুধু অনলাইন কনটেন্ট ক্রিয়েটর নন। মাঠ পর্যায়ে গিয়েও কৃষকদের সঙ্গে কাজ করেন তিনি। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কৃষকদের আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। তার এই প্রচেষ্টায় অনেক নারীও কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।
পপি নিজেই একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। তার তৈরি বিভিন্ন কৃষিপণ্য স্থানীয় বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।
উম্মে কুলসুম পপি প্রমাণ করেছেন, সঠিক পরিকল্পনা, অধ্যবসায় আর ভালোবাসা থাকলে যে কোনো ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব। তিনি কৃষিক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। তার উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
বর্তমানে পপির ফেসবুক পেজে ২৪ লাখের বেশি ফলোয়ার রয়েছে এবং ইউটিউবে তার সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। তার প্রতিটি ভিডিও লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যায় এবং কৃষি বিষয়ক জ্ঞানের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উম্মে কুলসুম পপি শুধু একজন সফল উদ্যোক্তা নন, বরং কৃষিক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী একজন অগ্রণী নারীর নাম। তার সংগ্রাম, সাফল্য ও অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।