
ধান নদী খাল– এই তিনে বরিশালের যে পরিচিতি তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ এই বিভাগের কৃষকরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তরমুজ চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাজারে। বসন্তের বাজার দখল করে রেখেছে গ্রীষ্মের ফল তরমুজ। আর এর লাভ পাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমের পরই আমনের আবাদ হয়। ভরপুর মৌসুম শুরুর আগে তরমুজ বাজারে বিক্রি করতে পারলে দাম বেশি পাওয়া যায়। এ জন্য এই অঞ্চলের চাষিরা তরমুজের আগাম আবাদে ঝুঁকেছেন। তারা জমিতে আমন আবাদ করেন না। কার্তিক-অগ্রহায়ণে তরমুজের আবাদ করেন। ফসল পাওয়া যায় মৌসুম শুরুর এক মাস আগে।
চাষিরা ধান বাদ দিয়ে তরমুজ চাষে ঝোকায় চিন্তায় পড়েছেন কৃষি অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তারা। তাদের মতে, এতে দোফসলি জমি পরিণত হচ্ছে এক ফসলিতে। এ খাতে কৃষি ঋণ না থাকায় তরমুজ চাষিদের ঘরে ঢুকছে ‘দাদন’ (১০ শতাংশ লাভে টাকা বিনিয়োগ)। প্রতি মৌসুমে কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে আড়তদাররা চাষিদের দাদন দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া স্থানীয় কালো টাকা এ খাতে বিনিয়োগ হয়। আসলসহ মোট বিক্রির ওপর সুদ হিসাব করা হয়।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে তরমুজের আবাদ বৃদ্ধি ও ধানের আবাদ কমার সত্যতা মিলেছে। বিভাগের ছয় জেলায় এ বছর তরমুজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ হাজার ৩৪৪ হেক্টর জমি। আবাদ হয়েছে ৪৯ হাজার ৮৬৯ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৫২৫ হেক্টর বেশি। গত বছর ৪৮ হাজার ৪৭ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল। সেই হিসাবে গত বছরের তুলনায় এ বছর ১ হাজার ৮২২ হেক্টর বেশি জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। অন্যদিকে গত বছর ৭ লাখ ১ হাজার ৯০৩ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছিল। এ বছর আবাদ হয়েছে ৬ লাখ ৯৫ হাজার ৬২৪ হেক্টর জমিতে। গত বছরের চেয়ে ৬ হাজার ২৭৯ হেক্টর কম। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে ৯৯ দশমিক শূন্য ৮ ভাগ।
কৃষি অধিদপ্তরের বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যানুয়ায়ী, দেশে মোট তরমুজ আবাদের ৬৫ ভাগ হয় বরিশাল বিভাগে। বিভাগের মধ্যে ভোলা, পটুয়াখালী ও বরগুনা হলো প্রধান আবাদ ক্ষেত্র। অন্য তিন জেলা বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরে বিচ্ছিন্নভাবে আবাদ হয়।
আমন বাদ দিয়ে আবাদ করা আগাম তরমুজে এবার রমজানের শুরুতে বাজার ভরপুর। মাঝারি আকারের (৬ কেজি ওজনের মধ্যে) তরমুজ ২০০ থেকে ৩০০ টাকা এবং এর চেয়ে বড় আকার ৪০০ টাকার ঊর্ধ্বে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ৬০ টাকা। এর দাম গত বছর রমজানের শুরুতে ছিল ৮০ টাকা কেজি। চাষি ও ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, বৃষ্টি না হওয়ায় এবার ফলন বেশ ভালো হয়েছে। মৌসুম সবে শুরু। সামনের দিনগুলোতে সরবরাহ যত বাড়বে, দাম তত কমবে।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোট বাইশদিয়া গ্রামের মিথেল হাওলাদার এ বছর ১০ কানি (৮০ শতাংশে ১ কানি) জমিতে তরমুজ আবাদ করেছেন। এতে ৩৫-৩৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ক্ষেতের অর্ধেক তরমুজ বিক্রি করে খরচের টাকা প্রায় উঠেছে। অবশিষ্ট তরমুজ বিক্রিতে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা লাভ হবে। ১০ কানি জমিতে আমন ধান আবাদ করে সর্বোচ্চ ১ হাজার মণ ধান পেতেন। খরচ বাদ দিয়ে সর্বোচ্চ লাভ হতো ৭ লাখ টাকা। মিথেলের হিসাবে ধানের চেয়ে তরমুজে দ্বিগুণ লাভ। বিভাগের কয়েকটি উপজেলার কমপক্ষে ১০ জন চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তরমুজ আবাদ উপযোগী উপজেলাগুলোতে বেশির ভাগ কৃষক এখন আমন বাদ দিয়ে তরমুজে ঝুঁকেছেন।
ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার ধলারচর গ্রামের চাষি নাসির হাওলাদার জানান, তিনি দেড় একরে আমন না দিয়ে তরমুজের আগাম চাষ করেছেন। গত বুধবার দেড় হাজার পিস তরমুজ ট্রলার বোঝাই করে বিক্রির জন্য বরিশাল নগরীর পোর্ট রোড মোকামে আনেন।
আমন বাদ দিয়ে তরমুজ চাষের বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান। তিনি সমকালকে বলেন, তরমুজ আবাদে যা খরচ হয়, লাভ হয় তার তিন গুণ। ফলে তরমুজের আগাম চাষ করতে আমন বাদ দেওয়াটা প্রতিবছর বাড়ছে।
এর কয়েকটি ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, তরমুজ চাষিরা অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। ফলে কয়েক বছর পর ওই জমিতে কোনো ফসল ফলে না। তরমুজে লাভ যেমন বেশি, আবাদ খরচ ধানের চেয়ে অনেক বেশি। তরমুজে কৃষিঋণ নেই। চাষিরা দাদন নিচ্ছেন। এ দাদন দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। রাঙ্গাবালীতে এ বছর প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমি আমন অনাবাদী রেখে তরমুজ আবাদ করা হয়েছে।
বাউফল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মিলন বলেন, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে আমন আবাদ আশংকজনকভাবে হ্রাস পাবে। চাষিদের আমন আবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তারা উঠান বৈঠক করছেন।
বরগুনার পরিবেশকর্মী আরিফুর রহমান বলেন, বর্তমানে বাজারে যে তরমুজ আসছে, সেগুলো দ্রুত বড় হতে চাষিরা অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও হরমোন প্রয়োগ করেন। এ তরমুজ খাওয়া ক্ষতিকর।