চীন কেন মাছ চাষে প্রথম?

সম্পাদকীয়/
মৎস্যবিদ মো: রাশেদুজ্জামান দিপু

(৩ সপ্তাহ আগে) ১৩ নভেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১১:৪০ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৭ পূর্বাহ্ন

agribarta

চীনে মাছের রোগ নিয়ন্ত্রণের নীতি হল Profylaxis: Prevention is Better then Treatment. “চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।” এর মানে রোগ নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি হলো প্রতিরোধ।

পক্ষান্তরে আমরা বাংলাদেশে কী করি? যখন কোনো ডিজিজ ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায় তখন আমরা ট্রিটমেন্ট শুরু করি। 

এতে আমাদের খামারিদের খরচ অনেক বেশি হয়, কিছু মাছে মর্টালিটি আছে, খাবার অপচয় হয়, টক্সিক গ্যাস সৃষ্টি হয়, মাছের ওজন কমে যায়। যদি আমরা চীনাদের মতো নিয়মিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতাম, তাহলে কিন্তু উপরোক্ত ক্ষতিগুলোর সম্মুখীন হতে হতো না।

সংক্রামক রোগ সাধারণত  মাছের টিস্যু এবং বিভিন্ন অঙ্গ (ত্বক, ফুলকা, অন্ত্র বা মলত্যাগের অঙ্গ) মাধ্যমে মাছকে আক্রমণ করে। তবে ত্বকের গঠন এবং মাছের শ্লেষ্মা ঝিল্লি সংক্রামক অণুজীবের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। পাচনতন্ত্রের প্রবেশকারী প্যাথোজেনিক জীবাণুগুলি মাছের অন্ত্রে থাকা প্রাকৃতিক জীবাণুনাশক দ্বারা নিধন হয়ে থাকে।

মাছের রক্তকণিকা, লিম্ফয়েড টিস্যু, প্লীহা, লিভার এবং রক্তনালীর রেটিকুলো এন্ডোথেলিয়াল কোষগুলি প্যাথোজেনিক অণুজীবকে নির্মূল করতে পারে। এছাড়াও, মাছের রক্তে ব্যাকটেরিসিডিন থাকে, যা প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়ার জন্য বিষাক্ত। কিন্তু শীতকালে পানি ঠান্ডা এবং সূর্যের আলো কম থাকায় মাছের এই প্রাকৃতিক ডিফেন্স ক্ষমতা অনেকাংশে কমে যায়।

জলাশয়ে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী দুইভাবে সংক্রমিত হয়, 

১) প্রাইমারি ইনফেকশন এবং ২) সেকেন্ডারি ইনফেকশন। 
 

১) প্রাইমারি বা প্রাথমিক সংক্রমণ মাছের ইমিউনিটি ভেদে পুকুরের মধ্যেই তৈরি হয়। জীবাণু মাছকে সরাসরি অথবা স্বাস্থ্যকর মাছ রোগের বাহক হিসেবে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য দুর্বল মাছকে আক্রান্ত করে। কারণ একটি স্বাস্থ্যকর মাছ দুর্বল মাছের চেয়ে বেশি জায়গায় সাঁতার কাটে ফলে রোগজীবাণু সর্বত্র পৌঁছাতে পারে। 

২) সেকেন্ডারি ইনফেকশন বা গৌণ সংক্রমণ পুকুরের বাইরে থেকে প্রবেশ করে। যেমন, একটি রোগমুক্ত পুকুরে একটি রোগাক্রান্ত পুকুরের রোগাক্রান্ত বা দূষিত পলিমাটি, পানি, ব্যবহৃত জাল বা অন্যান্য মাছ-ধরা সরঞ্জাম, বিভিন্ন মাছ-খেকো পাখি দ্বারা রোগের আক্রমণ ঘটে।

চীনারা এক পুকুরে ব্যবহৃত সরঞ্জাম অন্য পুকুরে ব্যবহার করে না, এমনকি একেক পুকুরের জন্য আলাদা শ্রমিক নিয়োজিত করে। মূলত তারা বায়োসিকিউরিটি শতভাগ মেনে চলে।

চীনারা, তাদের জলাশয়ে মাছের পোনা ছাড়ার আগে হ্যাচারী থেকে আনা পোনাগুলোকে মৃদু জীবাণুনাশক দিয়ে পরিশোধন করে তারপর কালচার পুকুরে অবমুক্ত করে। আমাদের দেশে কয়জন খামারি এটা করে?

চীনারা তাদের পুকুরে খাদ্য প্রয়োগের নিয়মিত জায়গায় কাপড়ের পোঁটলা বা টিস্যু ব্যাগে বিভিন্ন জীবাণুনাশক (ব্লিচিং পাউডার/ পাউডার জীবাণুনাশক) বেঁধে রাখে। ফলে মাছ যখন খাদ্য খেতে আসে তখন কাপড়ের পোঁটলা থেকে নিসৃত জীবাণুনাশকের সংস্পর্শে এসে মাছ জীবাণুমুক্ত হয়। আমাদের দেশে কেউ কি এতসব সতর্কতা মেনে চলে?

চীনারা তাদের পুকুরে জৈব সার প্রয়োগের সময় প্রতি ৫০০ কেজি জৈব উপাদানের সাথে ১৫০ গ্রাম করে ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে নিয়ে তারপর প্রয়োগ করে। কারণ এই জৈব উপাদানগুলোতে বিভিন্ন রোগজীবাণু থাকতে পারে। আমাদের দেশে কি এটা করা হয়?

চীনারা শীত আসার আগে তাদের পুকুরের মাছের ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন হারবাল ইমিউনিটি বিল্ডার প্রয়োগ করে। যেমন: ২ কেজি রসুনের পেস্ট প্রতি ৫০০ কেজি ফিডের সাথে মিশিয়ে পর পর ৬ দিন একটানা খাওয়ায়। এছাড়াও প্রতি ৫ কেজি ফিডের সাথে ৪০ গ্রাম করে লবণ ৬ দিন একটানা খাওয়ায়। ফলে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশের কয়জন খামারি এটা করে?

এই সামান্য কয়েকটা পদ্ধতি মেনে আমরা যদি মাছ চাষ করি, তাহলে মাছ চাষে বিপ্লব ঘটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

                                      মৎস্যবিদ মো: রাশেদুজ্জামান দিপু                                           দপ্তর সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, 
বাংলাদেশ ফিশারিজ এক্সিকিউটিভ এসোসিয়েশন |
ন্যাশনাল সেলস ম্যানেজার, এভানকো বাংলাদেশ লিমিটেড