ঢাকা, ১৩ মে ২০২৫, মঙ্গলবার

প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জের খাল এখন মৃতপ্রায়



পরিবেশ

এগ্রিবার্তা ডেস্ক

(২ সপ্তাহ আগে) ২৭ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার, ১০:৪৯ পূর্বাহ্ন

agribarta

"প্রাচ্যের ডান্ডি" নামে পরিচিত নারায়ণগঞ্জের গৌরবময় ইতিহাসের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল এখানকার খাল-নদীগুলো। একসময় খালপথে সহজেই মালামাল পরিবহন হতো, আর এতে গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যের সমৃদ্ধ বসতি। কিন্তু সময়ের প্রবাহে নারায়ণগঞ্জের খালগুলো আজ প্রায় ইতিহাসের পাতায় বিলীন হয়ে গেছে। অধিকাংশ খাল হয় ভরাট হয়েছে, নয়তো অবৈধ দখলে চলে গেছে। যে কয়েকটি টিকে আছে, সেগুলোও পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে, দখলদারিত্ব আর দূষণের কবলে পরিবেশ চরমভাবে বিপর্যস্ত।

পরিবেশ ও পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসানের উদ্যোগে খাল উদ্ধার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও বাস্তবে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দায়িত্বে থাকলেও এখনো খাল উদ্ধারে বড় কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি।

উপজেলাভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রূপগঞ্জে রয়েছে ৩১টি, আড়াইহাজারে ২২টি, সোনারগাঁয়ে ১৩টি, বন্দরে ৯টি, সিদ্ধিরগঞ্জে ৬টি, ফতুল্লায় ৭টি এবং শহরে ৩টি খাল। একসময় এই খালগুলোর প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটেরও বেশি, যেগুলো বৃষ্টির পানি ধারণ ও নিষ্কাশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।

স্বাধীনতার পাঁচ দশকের মধ্যেই নারায়ণগঞ্জের অধিকাংশ খাল হারিয়ে গেছে। যেগুলো আছে, সেগুলোও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ভূমি অফিসের নথিতে দখলকারীদের নামের কোনো তালিকা নেই। মাঝে মাঝে লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও কার্যকর নজরদারি না থাকায় দ্রুতই পুরনো অবস্থায় ফিরে যায়। পরিবেশবিদরা বলছেন, কিছু মানুষের মুনাফার লোভে খাল ভরাট হয়ে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে।

নারায়ণগঞ্জের অতীত খালব্যবস্থার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একসময় এখানে ৯১টি খাল সচল ছিল, যা শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও বালু নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। মুঘল আমলে এই নদী-খালপথ ব্যবহার করেই বন্দরের প্রসার ঘটেছিল। সেই প্রবাহমান খালগুলো এখন অদৃশ্য প্রায়; তাদের স্থানে গড়ে উঠেছে বড় বড় দালানকোঠা। সরকারি নথিতেও বহু খাল সংক্রান্ত তথ্য হারিয়ে গেছে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তৈরি ৫৭ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, কীভাবে নারায়ণগঞ্জের খালগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। ৩০-৩২ বছর আগেও যেখানে বড় বড় নৌযান চলাচল করত, এখন সেখানে দুই-আড়াই ফুট চওড়া ড্রেনের মতো চিত্র দেখা যায়। একশ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রভাবশালীরা বছরের পর বছর ধরে খাল দখল করে রেখেছে, ফলে প্রকৃত অর্থে খাল উদ্ধার সম্ভব হয়নি।

এক সময় রূপগঞ্জের বাণিজ্যের প্রাণ ছিল টাটকী খাল। ১৯৮৪ সালে ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে অগ্রণী সেচ প্রকল্প চালু হয়েছিল এই খালকে ঘিরে। প্রায় ১,৫০০ একর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া হতো। কিন্তু এখন এই খাল অবৈধ দখল, ময়লা ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, শত বছরেরও বেশি সময় আগে জমিদার রামরতন ব্যানার্জি এ খাল খনন করেছিলেন নদীপথ বাণিজ্যের জন্য।

কাশিপুর-ভোলাইল খাল এখন দখলদারদের দখলে। খালটি এখন আর খাল মনে হয় না—দেখলে মনে হয় ড্রেনের মতো। শিল্পকারখানার বর্জ্য ও বাসাবাড়ির আবর্জনায় খালটি ভয়াবহভাবে দূষিত হয়েছে। এখানে একসময় মালবাহী বড় নৌকা চলত, এখন সেখানে দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতা চলছে।

সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক পঙ্খিরাজ খালও আজ ময়লার ভাগাড়ে পরিণত। এক সময় এই খালটি ছিল সোনারগাঁ পৌরসভার একমাত্র পানি নিষ্কাশন পথ। মেঘনার শাখা মেনিখালীর সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল এ খাল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল চালিকাশক্তি ছিল এই খাল, যা এখন প্রভাবশালীদের দখলে। খালটি উদ্ধারের জন্য স্মারকলিপি ও মানববন্ধন করলেও তেমন কোনো ফল হয়নি।

শত বছরের পুরোনো আরেকটি ঐতিহ্যবাহী খাল হলো বেহাকৈর খাল। এটি প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ হলেও বর্তমানে প্রায় পুরোপুরি দখল হয়ে গেছে।

রূপগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তারিকুল আলম জানান, দখলের অভিযোগের ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি চলছে।

নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাশেদ মাহমুদ বলেন, দূষণ রোধে অভিযান চলমান রয়েছে, তবে খাল উদ্ধার তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।

রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইফুল ইসলাম জানান, শীঘ্রই উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে।

জেলা প্রশাসক মো. জাহিদুল ইসলাম মিঞা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে বন্দরের একটি খাল দখলমুক্ত করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে জেলার অন্য খালগুলোও উদ্ধার করা হবে।