ঢাকা, ২৭ জুলাই ২০২৪, শনিবার

গোল্ডেন রাইস নিয়ে টানাপোড়েন



কৃষি

দৈনিক ইত্তেফাক:

(১ মাস আগে) ৩০ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:২২ পূর্বাহ্ন

agribarta

দরিদ্র মানুষের ভিটামিন ‘এ’র ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) উদ্ভাবন করেছে ‘গোল্ডেন রাইস। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও এ ধানের জৈবনিরাপত্তা বিষয়ক অনুমোদনও মেলেনি। ইতিমধ্যে ধান গবেষণার আন্তর্জাতিক সংস্থা ইরির প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে এই ধানের অনুমোদন দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। 

অন্যদিকে এই ধানের অনুমোদন না দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। ফলে দেড় যুগ ধরে গবেষণা করে উদ্ভাবন করা এই ধানের অনুমোদন নিয়ে এক প্রকার অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

গোল্ডেন রাইস বা সোনালি চাল হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে উদ্ভাবিত একধরনের পুষ্টি চাল, যাতে রয়েছে বিটা ক্যারোটিন। ‘প্রোভিটামিন-এ’ এই উদ্ভিদ রঞ্জকটি খাবার পর শরীর প্রয়োজন অনুযায়ী ‘ভিটামিন এ’তে রূপান্তর করে। এই যৌগটির কারণে শস্যটি হলুদ-কমলা বা সোনালি রঙ ধারণ করায় এর নাম হয়েছে ‘গোল্ডেন রাইস’ বা ‘সোনালি চাল’।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিআর-২৯ জাতের ধানের সঙ্গে ভুট্টার জিন মিলিয়ে এই গোল্ডেন রাইসের জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশে এই ধান নিয়ে কাজ শুরু করে ব্রি। সরকারি এই সংস্থাটি বলছে, একজন মানুষের ‘ভিটামিন-এ’র দৈনিক যে চাহিদা, তার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত গোল্ডেন রাইসের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব। বাকি চাহিদা ফলমূল, শাকসবজি বা প্রাণিজ উৎস থেকে পূরণ করা যেতে পারে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট আট বছর এই ধান নিয়ে গবেষণা করে ব্রি। কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে ২০১৭ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে গোল্ডেন রাইসের জৈবনিরাপত্তা (বায়োসেফটি) বিষয়ক অনুমোদনের জন্য আবেদন করে ব্রি। কিন্তু পরিবেশগত ছাড়পত্র না পাওয়ায় এ চাল উত্পাদন ও বাজারজাতের সুযোগ মিলছে না। ব্রি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের চিঠি চালাচালিতেই এখন সময় পার করছে।

গবেষণার শুরু থেকেই গোল্ডেন রাইস নিয়ে কৃষিবিজ্ঞানী এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের প্রচার-প্রচারণা শুরু করে। পালটাপালটি সভা-সেমিনারও হয়েছে।

ব্রিসহ বিভিন্ন কৃষি গবেষণা সংস্থাগুলো এই ধানের পক্ষে বিভিন্ন ধরনের সভা সেমিনার করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি পরিবেশবাদী সংগঠনসহ সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা এই ধানের বিভিন্ন ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরে সভা সেমিনার ও সংবাদ সম্মেলন করছেন।

গত এপ্রিল মাসে ইরির একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে গোল্ডেন রাইস ধানের জাত অবমুক্তির জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করেছে। আর সরকার অনুমোদনের আশ্বাসও দিয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা।

তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) ফিলিপাইনে অবস্থিত। এই দেশটি ২০২১ সালে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইস অনুমোদন দেয়। তবে এর তিন বছর পর চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল ঐ ‘গোল্ডেন রাইস’ নামের ধান উত্পাদন এবং তা বাণিজ্যিকীকরণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ফিলিপাইনের একটি আদালত। 

এই ধান উৎপাদন পরিবেশ এবং মানবদেহের জন্য মারাত্মকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে ঐ আদালত। ১৪টি পরিবেশবাদী সংগঠন এর বিরোধিতা করে আদালতে মামলা করেছিল। বাংলাদেশ সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা এ বিষয়টিও সামনে নিয়ে এসেছেন।

তারা বলছেন, অন্য কোনো দেশ গোল্ডেন রাইসের বাণিজ্যিক অনুমোদন দেয়নি। ফিলিপাইনের আদালত সুনির্দিষ্টভাবে এ অনুমোদনের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। বাংলাদেশে ভিটামিন ‘এ’র বিকল্প প্রাকৃতিক উৎস সহজলভ্য। অথচ এদেশে ভিটামিন ‘এ’ বেশি পাওয়ার অজুহাতে জিনগতভাবে পরিবর্তিত ও কোম্পানির পেটেন্টকৃত গোল্ডেন রাইসের বাণিজ্যিক প্রচলন করার কোনো সুযোগ নেই। 

বিটি বেগুন বাংলাদেশ, ভারত ও ফিলিপাইন একই সঙ্গে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করলেও বাংলাদেশ ছাড়া ভারত কিংবা ফিলিপাইন বাণিজ্যিক প্রচলনের অনুমোদন দেয়নি।

এ বিষয়গুলো তুলে ধরে চলতি সপ্তাহে একটি বিবৃতিতে দিয়ে এ ধানের অনুমোদন না দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন ১৮টি বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা। 

চিঠিতে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, ‘নিজেরা করির’ সমন্বয়কারী খুশী কবির, উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ বিশিষ্ট নাগরিকরা স্বাক্ষর করেছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশের মতো প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভরশীল দেশে জিনগতভাবে পরিবর্তিত ধান ও খাদ্য ফসলের প্রবর্তন উদ্বিগ্ন করেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের।

পরিবেশ সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা বলছেন, ব্রি-২৯-এর পেটেন্ট সিনজেন্টা কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হলে দেশের কোটি কোটি কৃষকের ধানের এই জাত চাষ করা অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে।

তবে এর জবাবে কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্রি ধান-২৯ (গোল্ডেন রাইস)-এর পেটেন্ট সিনজেন্টা কোম্পানিকে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এটা আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) কারিগরি সহায়তায় ব্রি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত একটি জাত। ব্রি উদ্ভাবিত অন্য ১১৫টি জাতের মতো এর স্বত্ব কেবল ব্রির হাতেই থাকবে। যার বীজ কৃষক নিজেই উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বাজারজাত ও ব্যবহার করতে পারবে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ব্রি বা এর বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে কথা বলে, অনুমান বা আবেগের ভিত্তিতে নয়। ব্রির বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে এই চাল নিয়ে নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন যে, এটি মানব শরীর, পশুপাখি ও পরিবেশের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। ব্রি ধান-২৯ যতটুকু নিরাপদ, গোল্ডেন রাইসও ততটুকুই নিরাপদ। 

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এই চাল পরীক্ষা করে বলেছে এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। একই কথা বলেছে হেলথ কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ফুড স্ট্যান্ডার্ডসের মতো প্রতিষ্ঠানও। বিশ্বের কোনো গবেষণা বা কোনো জার্নালে জিএম ফসলের পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য ঝুঁকির বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি।