
রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার তিস্তা নদীবেষ্টিত চরের উৎপাদিত মিষ্টি কুমড়া এবার রফতানি হচ্ছে। রংপুর এগ্রো নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এক মাসে ২০০ টন মিষ্টি কুমড়া মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছে। যার মূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এখানে উৎপাদিত কুমড়ার গুণগত মান উন্নত হওয়ায় বিদেশে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। চলতি মৌসুমে প্রায় ২০ কোটি টাকার মিষ্টি কুমড়া রফতানির আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকের মাঝে স্বস্তি দেখা গেলেও চরের বেশকিছু মিষ্টি কুমড়ার খেতে মোজাইক ভাইরাসের আক্রমণ হওয়ায় ফলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্ক করছেন অনেকেই।
গংগাচড়া উপজেলার একাধিক স্থান থেকে মিষ্টি কুমড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা ট্রাকভর্তি করে নিয়ে গেলেও মূলত গজঘন্টা ইউনিয়নের মতলেব বাজার থেকে মিষ্টি কুমড়া বিদেশের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মতলেব বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৩০ নারী ও পুরুষ উপজেলার ইচলি সালাপাক, জয়রাম মৌজা ও লক্ষ্মটারি চরে উৎপাদিত মিষ্টি কুমড়া কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করার পর ২০ কেজি এবং ৫০ কেজির ওজনের বস্তায় প্যাকেজিংয়ের কাজ করছেন। এ সময় পরিষ্কার কাজে ব্যস্ত থাকা ষাটোর্ধ্ব নারী শ্রমিক ফুল জাহান বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে এ কাজ করছি। আরো দুই মাস এ প্যাকেজিংয়ের কাজ চলবে। প্রতিদিন তিনি মজুরি পান ৩০০ টাকা। এবার মিষ্টি কুমড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও বিদেশে রফতানি হওয়ায় কাজের বেশ চাপ। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। তার পরও এ বয়সে এমন কাজ তার জন্য অনেক ভালো হয়েছে।’
রংপুর এগ্রোর কর্ণধার হাবিবুর রহমান রতন মিয়া বলেন, ‘গংগাচড়া উপজেলার চরাঞ্চলে উৎপাদিত ব্যাংকক-১ ও মনিকা জাতের মিষ্টি কুমড়া অন্য এলাকার উৎপাদিত কুমড়ার মতো সহজে পচন ধরে না। বিদেশেও বেশ চাহিদা। আমরা জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২০০ টন কুমড়া মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছি। আমি সরাসরি এবং কমিশনে অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে করে মিষ্টি কুমড়া বিদেশে পাঠাই।’
চলতি মৌসুমে প্রায় ২০ কোটি টাকার রফতানির টার্গেট আছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘মালের জোগান পেলে বর্তমানে উৎপাদিত মিষ্টি কুমড়ার চেয়ে দ্বিগুণ রফতানি করা সম্ভব। প্রতি কেজি মিষ্টি কুমড়া প্রকারভেদে ১৬-২০ টাকায় তিনি কৃষকের কাছ থেকে কিনছেন। প্রতি কেজিতে তার কমিশন থাকে কখনো ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা এবং ১ টাকা। মূলত ক্রয়ের ওপর কমিশন নির্ভর করে।
মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দ্য চরসের ইন্টারভেনশন এরিয়া ম্যানেজার মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘গংগাচড়ার চরের কৃষক যাতে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান সেজন্য কৃষি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগসূত্র করার কাজ আমরা করছি। এছাড়া কৃষককে প্রশিক্ষণসহ উন্নত বীজ সরবরাহে দেশের বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে দেয়ার কাজও করছি।’
এদিকে ইচলি সালাপাক, জয়রাম মৌজা একং লক্ষ্মটারি কোলকোন্দসহ একাধিক চরে ঘুরে দেখা গেছে, চরজুড়ে মিষ্টি কুমড়ার আবাদ, কিন্তু চরের বেশকিছু মিষ্টি কুমড়ার জমিতে মোজাইক ভাইরাসের আক্রমণ হওয়ায় ফলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্ক করছেন কৃষক।
জয়দেব সরকার পাড়ার কৃষক আতিয়ার রহমান বলেন, ২০ বিঘা জমিতে মিষ্টি কুমড়া আবাদ করেছি। আমার খরচ হয়েছে প্রায় ৩ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত ১০ লাখ টাকার মিষ্টি কুমড়া বিক্রি করেছি।তবে ফলন কম হয়েছে। জমিতে মিষ্টি কুমড়া বিক্রি করছেন ২০ টাকা কেজি দরে।’
সালাপাক চরের কৃষক মোহাম্মদ বলেন, ‘প্রথম দিকে মিষ্টি কুমড়ার ফলন ভালো পেয়েছি, কিন্তু পরে ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে।বিষয়টি আমরা কৃষি অফিসকে জানিয়েছি। তারা বলেছেন, এটি মোজাইক ভাইরাস, যা পোকা এমনকি বাতাসের মাধ্যমেও ছড়ায়।’
বিভিন্ন প্রশিক্ষণের অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘আগের বছরের পুরনো বীজ পরের বছর ব্যবহার করলে এ সমস্যা সাধারণত বেশি হয়।’
একাধিক কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মোজাইক ভাইরাসে আক্রান্ত জমি থেকে আর কতটুকু ফলন পাবেন—এ নিয়ে আশঙ্কা থাকলেও এবারই প্রথম মিষ্টি কুমড়া বিদেশে যাওয়ায় ভালো দাম পাওয়া পাচ্ছেন কৃষক। এ কারণে খুশি তারা।
গংগাচড়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর উপজেলার ইচলি, সালাপাক, জয়রাম মৌজা, লক্ষ্মটারি, কোলকোন্দ এবং নোহালীসহ বিভিন্ন চরে প্রায় ১১০ হেক্টর জমিতে মিষ্টি কুমড়া আবাদ হয়েছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা একে এম ফরিদুল হক বলেন, ‘উৎপাদিত মিষ্টি কুমড়া এবারে প্রথম বিদেশে রফতানি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, চরে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতে বিভিন্ন এনজিও তাদের সঙ্গে কাজ করছে।মিষ্টি কুমড়ার জমিতে মোজাইক ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোজাইক ভাইরাস আক্রান্তর শুরুতে যদি গাছটি তুলে ফেলা যেত তাহলে আক্রান্ত অনেক কমে যেত। কারণ আক্রান্ত গাছে কোনো পোকা বসার পর যদি অন্য সুস্থ গাছে বসে তাহলে সে গাছটিও ভাইরাস আক্রান্ত হবে। বর্তমানে আক্রান্ত জমি চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কৃষি বিভাগ কাজ করছে।