agribarta

ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গবেষণা অনুদান ছাড়া কি বিজ্ঞান শিক্ষা হয়?


গবেষণা

(২ সপ্তাহ আগে) ৬ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১০:৫০ পূর্বাহ্ন

agribarta

সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদের গবেষণার জন্য অনুদান প্রদান করে থাকে। প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদের দিয়ে যাচ্ছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এ গবেষণা অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ, প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণা ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প, বিজ্ঞানভিত্তিক পেশাজীবি সংস্থা/সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি সম্প্রসারণে সেমিনার ও প্রদর্শনী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক/গবেষকদের জন্য বিশেষ গবেষণা অনুদান অন্যতম। 

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপের আওতায় মোট ৫৭১ জনকে দেশে ও বিদেশে এমএস, পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরালের জন্য ফেলোশিপ প্রদান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপের আওতায় মোট ২৯ হাজার ৬১২ জন শিক্ষার্থীকে ১৮০ কোটি ৯১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৫০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক ও গবেষকদের বায়োলজিক্যাল সায়েন্স, মেডিকেল সায়েন্স, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ফিজিক্যাল সায়েন্স ও ইন্টার ডিসিপ্লিনারি গ্রুপে ২০২৩-২৪ সাল পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৯৮টি প্রকল্পের অনুকূলে মোট ২২১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বিশেষ গবেষণা অনুদান প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এ কার্যক্রম দেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১১ মার্চ ২০২৪-এ তার কার্যালয়ের শাপলা মিলনায়তনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য নির্বাচিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ১০ জনকে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ, ১৯ জনকে বিশেষ গবেষণা অনুদান ও ২৫ জনকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ দিয়েছেন। এসব ফেলোশিপের আওতায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষক রয়েছেন। 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্বাচিত ফেলোরা দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত হচ্ছেন। গবেষণার মাধ্যমে তাদের অর্জিত ফলাফল দেশে ও বিদেশে সুনাম অর্জন করছে, যা ভবিষ্যতে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বৃত্তিপ্রাপ্ত অনেক ছাত্র-ছাত্রী বিশ্বের র‌্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত হচ্ছেন। ফলে একদিকে যেমন গবেষণার দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে; অন্যদিকে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ সরকারের ভাবমূর্তিও অলংকৃত হচ্ছে। ডিগ্রি অর্জনের পরবর্তী কার্যক্রম হিসাবে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ফেলোরা গবেষণা অব্যাহত রাখার জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অধ্যাপকদের সঙ্গে কোলাবোরেশনও করে যাচ্ছেন। 

যেহেতু ফেলোরা বাংলাদেশের টাকায় বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন, সেহেতু তাদের দেশে ফেরার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান দেশে প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকরাও ওই ডিগ্রি অর্জনের জন্য গঠিত অ্যাডভাইজরী কমিটির সদস্য হিসাবে নিজেদের সংযুক্ত করতে পারেন। ফলে দেশে কর্মরত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও উন্নত দেশের গবেষণার সঙ্গে নিজেদের অতিসহজেই সংযুক্ত করতে পারছেন। 

মোটা দাগে বলা যেতে পারে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রচেষ্টায় দেশে এমএস ও পিএইচডি ডিগ্রির সংখ্যা ও শিক্ষার গুণমান বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশে প্রায় ৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আবার ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদনও রয়েছে, যা ভবিষ্যতে দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্তারে সহায়ক হবে। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের ল্যাবরেটরি থাকা সত্ত্বেও গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস ও পিএইচডি ডিগ্রির জন্য থিসিস বাধ্যতামূলক, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ জরুরি। 

অনেক ক্ষেত্রে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় অর্থ বরাদ্দ কম হওয়ায় গবেষণার মানও হয় নিম্নমুখী। সেক্ষেত্রে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রদের গুণমানসম্পন্ন থিসিস করতে অনেকটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত গবেষণা অনুদান, গবেষণাভিত্তিক ডিগ্রি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ছাড়াও গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গবেষণালব্ধ ফলাফল বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের প্রভাষক থেকে গ্রেড-১ অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। 

সে লক্ষ্যে, প্রতিবছর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের গবেষণার জন্য বিশেষ গবেষণা অনুদান দিয়ে যাচ্ছে, যা তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশের পাশাপাশি পদোন্নতির জন্য দক্ষতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রধানমন্ত্রী গবেষণা অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নতুন নতুন আবিষ্কারের দিকে মনোযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। বিজ্ঞানচর্চা ছাড়া একটি দেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। 

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও গবেষকদের গবেষণায় মনোযোগ বাড়ানোর উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী কৃষিবিজ্ঞানের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, কৃষিক্ষেত্রে গবেষণার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে খরা, লবণাক্ত ও জলমগ্ন সহিষ্ণু ধানের চাষাবাদ হচ্ছে, যা বিজ্ঞানীদেরই গবেষণার ফলাফল। অন্যদিকে তিনি স্বাস্থ্যকর্মীদেরও গবেষণায় মনোযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর মতে, গবেষণার মাধ্যমে মানসম্মত ওষুধ আবিষ্কারের পাশাপাশি মানুষকে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা উল্লেখ করে বলেন, বিদেশিদের পাশাপাশি বাংলাদেশি বহু বিজ্ঞানী পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অবদান রেখেছেন। 

আশা করা যায়, বাঙালি জাতি তাদের গবেষণার মাধ্যমেই বিশ্বের মানচিত্রে নিজেদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশে আরও একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পাবনাতেই স্থাপিত হবে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি ভবিষ্যতে প্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই গবেষণার মাধ্যমে একটি দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কানাডা ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পণ্য উদ্ভাবিত হচ্ছে। এসব উৎপাদিত পণ্য ও প্রযুক্তি পেটেন্টের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক ও গবেষকরা নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। 

বাংলাদেশের গবেষক ও শিক্ষকরা উন্নত দেশের তুলনায় সীমিত পরিসরে হলেও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা তহবিল বাড়ানো যায়, তাহলে ভবিষ্যতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও উন্নত দেশের র‌্যাংকিং-এ থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও নতুন পণ্য আবিষ্কারের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারবে বলে আশা করা যায়।

যা হোক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন বিজ্ঞানমনস্ক রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান। যেখানে তিনি বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছেন। আশা করা যায়, প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যতে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার জন্য আরও বেশি গবেষণা অনুদান প্রদান করবেন, যার মাধ্যমে ভিশন ২০৪১ অনুযায়ী গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব হবে।

  • ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর