সন্ধ্যামালতীর গল্প

সম্পাদকীয়/
মৃত্যুঞ্জয় রায়

(১১ মাস আগে) ৯ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ৩:০৪ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৮:২৯ পূর্বাহ্ন

agribarta

চৈত্রের এক সকালে চুয়াডাঙ্গার কলেজ রোডে হাঁটতে হাঁটতে পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের কাছে একটা চায়ের দোকানের সামনে এসে থেমে গেলাম। রাস্তার পাশে দেয়াল ঘেঁষে দুই বেঞ্চের একটা ছাপরা দেওয়া ছোট্ট দোকান। দোকানের দুই পাশে দুর্বল নাইলন জালের বেড়া দিয়ে ঘেরা দুটি ফুলবাগান।

সে বাগানে অনেকগুলো সন্ধ্যামালতী আর নয়নতারা ফুলের গাছ। বসন্তের ঘোষণা দিচ্ছে গাছগুলো, ডালপালা ঝেপে ফুল ফুটে আছে। সন্ধ্যামালতী আর নয়নতারা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের দুটি বিশেষ ফুল। কে এমন করে এখানে লাগাল এতগুলো এই বিশেষ দুটি ফুলের গাছ?

চায়ের দোকানি কাচের কাপে টং টং করে চা বানানোর আওয়াজ তুলছিলেন। তাঁর নাম মোহাম্মদ আশরাফুল হক। গ্রামের বাড়ি বলিয়ারপুর। সন্ধ্যামালতী ও নয়নতারা ফুল দেখার পর মনে হলো ইনি কি তবে নজরুলপ্রেমী! কথা বলে জানা গেল, ফুলটার নাম যে সন্ধ্যামালতী, তা তিনি জানেন।

চায়ের দোকানে অনেকে এসে বসেন, চা খান,Ñফুলের শোভা তাঁদের আনন্দ দেয়। কোনো যত্নœছাড়াই এসব ফুলগাছ বেঁচে আছে বছরের পর বছর, সারা বছর ফুল ফোটে। বছর তিনেক আগে তিনি এ ফুলগুলো লাগিয়েছিলেন। তিনি সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছেন সন্ধ্যামালতীর অনেকগুলো জাত। দেখলাম, কোনো কোনো গাছে মাইকের চোঙের মতো ফুটেছে ম্যাজেন্টা ফুল, কোনো গাছে রক্তলাল।

আবার কোনো কোনো গাছে ফুটেছে হলুদ, কোনো কোনো গাছে কমলা ও সাদা ফুল। অবাক হলাম, একই গাছে ফুলের বহু রূপ দেখে। একরঙা ফুলের গাছ হলেও সেখানে ফুটছে সেই রঙের মধ্যে মিশ্রিত রঙের কিছু ফুল—হলুদের মধ্যে ম্যাজেন্টা, সাদার মধ্যে ম্যাজেন্টা। এ জন্যই হয়তো লেখক তারাপদ রায় লিখেছিলেন, ফুলগুলো ফোটার আগে ঠিক বোঝা যায় না যে কোন গাছে কোন রঙের ফুল ফুটবে।

সাহিত্যিক তারাপদ রায় তাঁর সন্ধ্যামালতী গল্পে অক্ষর দিয়ে রাঙিয়েছেন সন্ধ্যামালতী ফুলের এক চমৎকার ছবি। লিখেছেন, ‘সূর্যদেব যখন অস্তাচলে, দিগ্বধূর ললাটে যখন সন্ধ্যাতারা সিন্দুর বিন্দুর মতো জ্বলে ওঠে, আকাশের আনাচে-কানাচে যখন একটি দুটি করে গ্রহ-নক্ষত্র বেরিয়ে আসে, যখন সব পাখি ঘরে ফেরে, সব নদী, সেই সময় সন্ধ্যামালতী ফুল ফুটে ওঠে মর পৃথিবীর গৃহস্থ বাড়ির প্রাঙ্গণে। আবছায়া অন্ধকার উঠোনে, সিঁড়ির পাশে, বারান্দার নীচে সন্ধ্যামালতী ফুলগুলি আকাশের তারার মতো ঝলমল করে।’

ফুলটা দেখতে কেমন, সে কথাও তিনি সে গল্পে যথার্থ লিখেছেন, ‘লাল-নীল-সাদা, সবুজ-হলুদ ঘুড়ি বানানোর রঙিন কাগজের মতো সন্ধ্যামালতী ফুলের নানা রকম রং।...দিনের বেলায় এ ফুল ঘুমিয়ে থাকে, জেগে ওঠে রোদ মুছে যাওয়ার পরে দিনের অবসানে। একে একে ফুটে ওঠে উঠোনে, অঙ্গনে।...পেঁপের বিচির মতো, গোলমরিচের মতো কালো-কালো, গোল সন্ধ্যামালতী ফুলের বিচি শুকিয়ে গেলে প্রকাণ্ড চাই ঝরে পড়ত।’

সন্ধ্যায় এ ফুল ফোটে বলেই এর নাম সন্ধ্যামালতী, অন্য নাম সন্ধ্যামণি বা কৃষ্ণকলি। গ্রামে কেউ কেউ একে কেষ্ট ফুলও বলেন। ইংরেজি নাম মার্ভেল অব পেরু, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Mirabilis jalapa, গোত্র নিকটাগিনেসি। গুয়াতেমালার জালাপায় ফুলটার জন্ম হলেও এ ফুলটা এখন আমাদের দেশি ফুল।

ছোটবেলায় নড়াইলে আমাদের গ্রামের বাড়িতেও এ গাছ অনেক ছিল। ম্যাজেন্টা লাল ও হলুদ ফুল ফুটে গাছ সারা বছর ভরে থাকত। তবে বসন্তে ফুলের উচ্ছ্বাসটা ছিল দেখার মতো। বর্ষার জল পেয়ে গাছগুলোর বাড়বাড়তি হতো খুব। ফুল শেষে ডালের আগায় হালকা সবুজ তিনটি বৃতির মাঝখানে উঁকি দিত কালো খসখসে গোলাকার মটরদানা বা গোলমরিচের মতো বীজ। সেগুলো তুলে মুঠি ভরে নিয়ে আসতাম।

বীজ পুঁততে হতো না, গাছ থেকে আপনা–আপনি নিচে মাটিতে পড়ে সেখানেই চারা গজাত। কি রোদ, কি বৃষ্টি, কি খরা, কি বানের মতো জলধারা, কি শীত, কি গরম, কিছুই যেন গাছগুলোকে কাবু করতে পারত না। সর্বংসহা সেসব গাছে বিকেল হলেই ফুল ফুটতে শুরু করত, সকালে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে যেত। ঘ্রাণ না থাকলেও ফুলের প্রাচুর্যে বিকেল আর সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির কোণটা যেন আলোময় হয়ে উঠত।

এখনো যেসব বাড়িতে এ ফুলগাছ দেখি, ঘন ঝোপ করে সেখানেই আলো করে ফোটে এ ফুল। ফুলগুলো দেখে এখনো মনে আসে কাজী নজরুল ইসলামের সন্ধ্যামালতী কবিতা ‘সন্ধ্যামালতী যবে ফুলবনে ঝুরে, কে আসি বাজালে বাঁশি ভৈরবী সুরে।’ অথবা ‘আমি সন্ধ্যামালতী বনছায়া অঞ্চলে/ লুকাইয়া রই ঘন পল্লব-তলে।’

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক