জমিতেই নষ্ট হচ্ছে কৃষকের সোনালি স্বপ্ন

কৃষি অর্থনীতি/
এগ্রিবার্তা ডেস্ক

(১০ মাস আগে) ২৯ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ৭:৪২ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৭:৪৯ পূর্বাহ্ন

agribarta

উত্তরের শস্যভান্ডার খ্যাত জনপদ গাইবান্ধা। জেলার সাত উপজেলায় সব ধরনের ফসলের চাষাবাদ হয়। চলতি বোরো মৌসুমে জেলার বিভিন্ন স্থানে আধা পাকা বোরো ধানে ব্লাস্ট ও ছত্রাক রোগ দেখা দিয়েছে। এতে জমির ধান শুকিয়ে চিটা হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। জমিতেই নষ্ট হচ্ছে কৃষকের সোনালি স্বপ্ন।

কৃষকদের অভিযোগ, সঠিক সময়ে কৃষি বিভাগের পরামর্শ না পাওয়ায় ফসলের এ ক্ষতি হয়েছে। কৃষি বিভাগের দাবি, কৃষকদের ব্রি-২৮ ও ২৯ চাষাবাদে নিরুৎসাহিত করা হলেও তারা তা মানছেন না। ফলে ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ২৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধান রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে আবাদ হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ২০৫ হেক্টরে। লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৭৪৫ হেক্টর কম আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ২৫ হাজার ৬৭৫ হেক্টর, সদর উপজেলায় ২১ হাজার ৬৯, পলাশবাড়ি উপজেলায় ১২ হাজার ৬১৭, সাদুল্লাপুর উপজেলায় ১৬ হাজার ৫৮০, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ৩১ হাজার ১২৪, সাঘাটা উপজেলায় ১৪ হাজার ৯১২ এবং ফুলছড়ি উপজেলায় ৬ হাজার ২২৮ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। এ বছর ৫ লাখ ৬২ হাজার ৮১৯ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব জমিতে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাতের বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এছাড়াও চাল সরু ও খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ব্রি-২৮, ব্রি-৫০, ব্রি-৮১, সুরভিসহ কয়েক জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ করা হয়েছে। যেসব জমিতে ব্রি-২৮, ২৯ ও ৮১ জাতের ধান রোপণ করা হয়েছে, সেখানে ধানের শীষ আসার সঙ্গেই তা পুড়ে চিটা হয়েছে। যা কৃষকদের ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

একদিকে বিদ্যুৎ সংকটে সেচের পানির অভাব, অন্যদিকে অনাবৃষ্টি। এসব প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে বোরো ধান চাষ করেছিলেন কৃষকরা। দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে জেলাজুড়ে ধান কাটার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ। তিন-চার দিনের মধ্যেই আক্রান্ত জমির ধানের শীষ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন করে জমির ধান এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে হাজারো কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সরেজমিনে জানা যায়, জমিতে শীষ বাদামি রং ও শীষের গিঁটে কালো রঙের দাগ। দূর থেকে ধান পাকা মনে হলেও বাস্তবে পচে নষ্ট হচ্ছে। কিছু কিছু জমিতে প্রায় ৮০ শতাংশ শীষই নষ্ট হয়েছে। অনেক এলাকায় ধান গাছের গোড়া পর্যন্ত ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানেও সাদা শীষ দেখা গেছে। জমিতে একাধিকবার বালাইনাশক প্রয়োগ করেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না ব্লাস্ট রোগ। আক্রান্ত জমি থেকে পাশের জমিগুলো রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছেন কৃষকরা। জেলা কৃষি বিভাগ আক্রান্ত জমির পরিমাণ নিরূপণ করলেও তা মাঠ পর্যায়ে আক্রান্ত ফসলের তুলনায় কয়েকগুণ কম।

কৃষকরা জানান, নির্দিষ্ট সময়ে সঠিক নিয়মে কৃষি পরামর্শ ও কীটনাশক প্রয়োগে ব্যবস্থাপনার অভাবেই হাজারো কৃষক ক্ষতির মুখে। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অনেকেই আবাদ করেছেন। চোখের সামনে ফসল নষ্ট হলেও কিছুই করতে পারছেন না তারা।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলার রামজীবন ইউনিয়নের বাজারপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ বলেন, ‘চার বিঘা জমির মধ্যে ১ বিঘা জমিতে ব্রি-৮১ ধান চাষ করেছি। ধান পাকার আগেই ব্লাস্ট রোগে সম্পূর্ণ জমির ধান নষ্ট হয়েছে। সব শীষ সাদা হয়ে গেছে। উৎপাদন খরচটাও তুলতে পারবো না।’

একই উপজেলার দহবন্দ ইউনিয়নের ধুমাইটারী গ্রামের কৃষক মঞ্জু সরকার বলেন, ‘ধার-দেনা করে আবাদ করেছি। হঠাৎ ব্লাস্ট রোগে সব শেষ করে দিলো। একাধিক বালাইনাশক দিয়েছি কিন্তু কাজ হয়নি। ধানের শীষের গোড়ায় কালো দাগ হয়ে মাথা হেলে যায়। সঠিক সময়ে কৃষি পরামর্শ পেলে কিছু ধান রক্ষা হতো।’

সদর উপজেলার বাদিয়াখালি গ্রামের আব্দুল মালেক বলেন, ‘দেড় বিঘা জমির ধান প্রায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। সব মিলে ১০ কেজি ধানও পাওয়া যাবে না। আমার সব শেষ। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আবাদ করেছি। এখন কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবো?’

পলাশবাড়ী উপজেলার পশ্চিম কুমারগাড়ি গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ব্রি-৮১ জাতের ধানের আবাদ করছিলাম। প্রায় ২৯ মণ ধান পাওয়ার আশা ছিল। ব্লাস্ট রোগে সেই জমির ৯০ ভাগ ধান নষ্ট হয়েছে। কীটনাশক ব্যবহার করেও রক্ষা করা যায়নি।’

সুন্দরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. রাশিদুল কবির বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে গিয়ে ব্লাস্ট রোগসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ব্লাস্ট রোগ একটি ছত্রাক জাতীয় রোগ। তাই প্রতি মাসে ফসলি জমিতে নিয়মিত স্প্রে করতে হবে। তাহলে ফসলের ক্ষতি হবে না।’

এ বিষয়ে গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘চলতি মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ১৯ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে ব্রি-২৮ ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ২২ হেক্টর জমিতে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হয়েছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ফসল রক্ষায় সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ চলমান।’