গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি, বিশেষ করে কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় দেশের কৃষি উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থায় এক ধরনের নতুন ধারা এসেছে। এই বিবর্তনের ফলাফল ও এর প্রভাবগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। আমাদের পরিবারও এই পরিবর্তনের অংশীদার হয়েছে। পাঁচ বছর আগেও আমাদের পরিবারের কৃষি পণ্যের চাহিদা পূরণ হতো পারিবারিক কৃষি থেকে। কিন্তু বর্তমানে, রংপুর ও ঢাকায় আমাদের দুই পরিবারই কৃষি পণ্যের জন্য বাজারের উপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কৃষি সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৩.৩% আসে কৃষি খাত থেকে, যেখানে দেশের ৪০% মানুষের কর্মসংস্থান এই খাতের সাথে সম্পর্কিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্যিক কৃষির উত্থান ঘটেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন গতিপ্রকৃতি এনেছে। পারিবারিক কৃষির ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক কৃষির ধনাত্মক প্রবৃদ্ধির এই পরিবর্তন শুধু আমাদের পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশের সর্বত্রই দৃশ্যমান।
২০২২ সালে বাংলাদেশে চাল উৎপাদন ছিল প্রায় ৩৭.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা পাঁচ বছর আগে থেকে ৩.৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে, সবজি ও ফল উৎপাদনেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশ এখন বছরে প্রায় ১৮.৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন করছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
আশার কথা হল, বাণিজ্যিক কৃষির উত্থান ঘটছে এবং এটি আমাদের অর্থনীতিকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, উন্নত কৃষি পদ্ধতি ও বাজার ভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাণিজ্যিক কৃষি একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে এই পরিবর্তন লক্ষণীয়। তারা এখন শুধুমাত্র নিজের পরিবারকে নয়, বরং বড় বাজারের চাহিদা মেটাতে উৎপাদন করছেন। এর ফলে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি নতুন গতিপ্রকৃতি যোগ হচ্ছে।
কৃষির এই বাণিজ্যিকীকরণের ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক কৃষি পদ্ধতির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও, বাণিজ্যিক কৃষির মাধ্যমে দেশের কৃষিপণ্যের মানও উন্নত হচ্ছে। এর ফলে দেশের কৃষিপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ এখন বছরে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন আম রপ্তানি করছে, যা দেশের রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
তবে, এই পরিবর্তন সত্ত্বেও আমাদের সামনে কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশে আমরা যেভাবে কৃষি বিমুখ হচ্ছি, এটি বর্তমানে দেশের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম ও আগামী দিনের নেতৃত্বকে কৃষির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের কৃষির প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কৃষি বিষয়ক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও উন্নত কৃষি প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নত বীজ, সার ও সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়াও, কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ও বাজারে সঠিক মূল্য পেতে সহায়তা করতে হবে।
কৃষির এই পরিবর্তনশীল ধারা ধরে রাখতে ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আমাদের সরকার, কৃষি বিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা ও কৃষকদের একসাথে কাজ করতে হবে। আমাদের দেশের কৃষি খাতকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এ জন্য আমাদের সবাইকে মিলিতভাবে কাজ করতে হবে এবং কৃষির প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়ন আমাদের দেশের আর্থিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। আমরা যদি পারিবারিক ও বাণিজ্যিক কৃষির সঠিক সমন্বয় করতে পারি, তবে আমাদের দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে। আমাদের দেশের কৃষিপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে এবং আমাদের কৃষকদের আর্থিক অবস্থারও উন্নতি হবে।
পরিশেষে, আমাদের বুঝতে হবে যে কৃষি আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। কৃষিকে শক্তিশালী করে আমরা দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করতে পারব এবং বিশ্বে একটি শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়তে পারব। এই লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে এবং কৃষির প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।