ধান শুকানো ও সংরক্ষণে যন্ত্রের ব্যবহারে কমবে খরচ, শ্রম ও সময়

কৃষি প্রযুক্তি /
মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর, বাকৃবি প্রতিনিধি

(১০ মাস আগে) ১৬ মে ২০২৩, মঙ্গলবার, ৫:২৮ পূর্বাহ্ন

agribarta

বছরের এই সময়টায় বোরো ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করে থাকেন বাংলার কৃষকরা। বাংলা বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য (এপ্রিল, মে ও জুন) পুরোটা সময় চলে এই ধান কাটা । বর্তমানে রিপার ও কম্বাইন্ড হারভেস্টর থাকায় খুব সহজেই ধান কেটে ঘরে তুলছেন হাওরসহ অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকরা। কিন্তু ধান কাটার পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ কাজ ধান শুকিয়ে তা সংরক্ষণ করা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় কৃষকদের।

অনেক সময় ধান শুকানোর পর্যাপ্ত জায়গা পায় না তারা ছোট হয়ে আসছে উঠান। আবার এদিকে গ্রীষ্মের শুরু থেকেই চলছে তাপদহ। প্রচন্ড রোদ আর গরমে মাঠে ধান শুকানোও অসম্ভব হয়ে উঠছে । তীব্র রোদে বার বার ধান উল্টেপাল্টে দিয়ে শুকানোও কষ্টসাধ্য। কড়া রোদে ছাতা দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। পাশাপাশি হুট করে চলে আসা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিতে পারে অপ্রস্তুুত কৃষকের মাঠভরা ধান। ভালোভাবে শুকানোর অভাবে ধান সংরক্ষণ করতে পারে না কৃষকরা। ছত্রাক ও পোকার আক্রমণেও নষ্ট হয় ধান। ফসল কাটা থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত অপচয় হয় প্রায় ১৫ ভাগ। যা রোধ করা গেলে বৃদ্ধি পাবে খাদ্য নিরাপত্তা। এজন্যে প্রয়োজন হবে আধুনিক কৃষি যন্ত্রের।

এ সমস্যার সমাধানে ধান শুকানো ও সংরক্ষণ পদ্ধতিকে যান্ত্রিকীকরণের আওতায় নেওয়ার জন্যে কাজ করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পোস্ট হারভেস্ট লস রিডাকশন ইনোভেশন ল্যাবের (পিএইচএলআইএল) একদল গবেষক। উদ্ভাবন করেছে বিএইউএসটিআর ড্রায়ার এবং কোকুন সমৃদ্ধ পাঁচ স্তরবিশিষ্ট হারমেটিক ব্যাগ। ড্রায়ারের মাধ্যমে রোদ বা বৃষ্টি যেকোনো সময়েই এবং যেকোনো জায়গায় এমনকি ঘরের বারান্দাতেও ধান শুকানো যায় খুব সহজেই। বায়ুরোধী কোকুন সমৃদ্ধ হারমেটিক ব্যাগে অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারে না। ফলে অভ্যন্তরীণ পোকামাকড় মারা যায়।

সনাতন পদ্ধতিতে সংরক্ষণে অপচয় হয় শতকরা প্রায় ৬ ভাগ। আবার ড্রায়ার ব্যবহারে অপচয় কমে ২-৩ ভাগ। সেক্ষেত্রে ড্রায়ার ও হারমেটিক ব্যাগের ব্যবহারে অপচয় কমাবে শতকরা প্রায় ৬ ভাগ। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, গত ২০১৯-২০ সালে ধানের মোট উৎপাদন ছিলো ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার ৩৩০ টন। এক্ষেত্রে শুকানো এবং সংরক্ষণে যন্ত্রের ব্যবহারে ধানের অপচয় প্রায় ২১ লাখ ২১ হাজার ৭১৯ টন রোধ করা সম্ভব হতো।  

পিএইচএলআইএলের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ও বাকৃবির কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, বাংলাদেশের কৃষি এখন আধুনিক, যান্ত্রিক এবং বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। নিজ উৎপাদনশীলতা এবং বাজারের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য। ধান লাগ লাগানো, কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই এসকল কাজে যন্ত্রের ব্যবহার কায়িক শ্রম ও সময় বাঁচায় প্রায় শতকরা ২০ ভাগ। বীজ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ কমায় শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ। আমরা মূলত পিছিয়ে আছি শস্য রোপন, কাটা, শুকানো এবং পরবর্তীতে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে।

তিনি আরও বলেন, সরকার কৃষির যান্ত্রিকীকরণে এখন ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার যে উন্নয়ন প্রণোদনায় ধান লাগানোর জন্য ট্রান্সপ্লান্টার এবং কাটার জন্য রিপার ও কম্বাইন্ড হারভেস্টর ব্যবহার করা হচ্ছে। ধান লাগানোর ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রায় শতকরা ৩ থেকে ৪ ভাগ, কাটার ক্ষেত্রে প্রায় ১০ ভাগ, শুকানোর ক্ষেত্রে প্রায় ২ থেকে ৩ ভাগ এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মাত্র ১ থেকে ২ ভাগ যন্ত্রায়ন  হয়েছে। কাজেই সরকার উন্নয়ন প্রণোদনাকে এসকল ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। আমরা গবেষণায় দেখেছি যে শুধুমাত্র ধান কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই এবং শুকানোতে প্রায় শতকরা ১৫ ভাগ ধান অপচয় হয়। এক্ষেত্রে ধান শুকানোর জন্য আমাদের উদ্ভাবিত বিএইউএসটিআর ড্রায়ার, সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন হারমেটিক ব্যাগ এবং কোকেইনের ব্যবহারে অপচয় কমিয়ে শতকরা ২ থেকে ৩ ভাগে আনা সম্ভব। এভাবে আমরা শুধু ধানের ক্ষেত্রে ধরলে অন্তত ৭ মিলিয়ন টন ধান রক্ষা করতে পারি। আগামীতে আমাদের বাড়তি জনসংখ্যার প্রায় ৪৯ শতাংশের খাবার আমার এই অপচয় রোধ করেই  জোগাড় করতে পারি। কাজেই যেসকল ক্ষেত্রে যন্ত্রায়ন কম হয়েছে সেদিকে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে তবেই আমরা দেশের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবো।

গবেষণা প্রকল্পটির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. চয়ন কুমার সাহা ড্রায়ারের বিষয়ে বলেন, আমাদের দেশে বিশেষ করে বোরো  মৌসুমে হঠাৎ বৃষ্টি, ঝড় এবং অতিবৃষ্টির কারণে ধান শুকানোতে বেগ পেতে হয় কৃষকদের। আবার শুকাতে না পারলে নষ্ট হয়ে যায় ধান। কৃষকের এই দুর্ভোগ কমাতেই কম সময়, কম খরচ ও কম কায়িক শ্রমে ধান শুকানোর জন্য আমরা এই ড্রায়ারের উদ্ভাবন করেছি। পাশাপাশি ড্রায়ারে শুকালে সনাতন পদ্ধতির তুলনায় অপচয় বাঁচে প্রায় ২ থেকে ৩ শতাংশ। এলপিজি গ্যাসচালিত আমাদের ড্রায়ারে ধানের মধ্যে বাষ্প প্রবাহিত করা হয় এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেন্সর ব্যবহার করা হয়। বীজ ধানের জন্য এই তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রী এবং খাবার ধানের জন্য ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস রাখা হয়

তিনি আরও বলেন, ফল ও সবজির ক্ষেত্রে কর্তন পরবর্তী অপচয় হয় প্রায় ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। এই অপচয় কমাতেও আমরা হাইব্রিড ড্রায়ার নিয়ে কাজ করছি। ড্রায়ারের ব্যবহারে কৃষক মৌসুমী ফসলগুলো শুকিয়ে পরবর্তীতে সরবরাহ করতে পারবে। যার ফলে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন। পাশাপাশি পুষ্টি সরবরাহও বজায় থাকবে সারাবছর।