
নতুন অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ৬ শতাংশ এবং ১৩ হাজার কোটি টাকা বেশি হবে। অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় এ ধরনের উদ্যোগ বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে। বাজেটে সবুজ অর্থনীতির (গ্রিন ইকোনমি) ওপর গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, সবুজ অর্থনীতিতে দেশকে এগিয়ে নিতে বেসরকারি খাতকে প্রাধান্য দিতে হবে, যা দেশের রাজস্ব আহরণের পাশাপাশি অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে। গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলন ও বণিক বার্তার যৌথ উদ্যোগে ‘জন-বাজেট সংসদ ২০২৩’ শীর্ষক আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে।
বাজেট আলোচনা সভাটি দুটি অধিবেশনে অনুষ্ঠিত হয়। ‘সবার জন্য সামাজিক সুরক্ষায় অর্থায়ন’ শীর্ষক প্রথম অধিবেশন শুরু হয় সকাল ৯টায়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এমপি এবং সভাপতিত্ব করেন পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। সঞ্চালনায় ছিলেন কেয়ার বাংলাদেশের গ্রামীণ অতিদারিদ্র্য কর্মসূচির পরিচালক আমানুর রহমান। সম্মাননীয় অতিথি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি।
এছাড়া ‘সবুজ অর্থনীতির রূপান্তরে অর্থায়ন’ শীর্ষক দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসির পরিচালক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম।
প্রথম অধিবেশনে ডা. মো. এনামুর রহমান এমপি বলেন, ‘এবারের বাজেটের মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা খাতে উপকারভোগীর সংখ্যা সাত লাখ বাড়বে। প্রতিবন্ধী, জেলেসহ ১৪৩টি প্রকল্পে এ বরাদ্দ ব্যয় করা হচ্ছে। এসব ভাতা ব্যয় করা হয় দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের জন্য। এবার আমাদের শতভাগ দারিদ্র্যসীমার আওতার মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১৫ সালে এ প্রোগ্রাম চালুর পর থেকে আমাদের দরিদ্রতা ৪২ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। আর অতিদারিদ্র্যের হার ২০ থেকে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘যদিও বলা হয়, করোনার পর বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে। কিছু মানুষ দারিদ্র্যসীমায় নেমে এসেছে। এটা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তুত আছেন। সেজন্য এবার বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার বাজেট বাড়ানো হচ্ছে। বৈশ্বিক সংকট ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এ ধরনের উদ্যোগ বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে।’
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘প্রতি ডলারের জন্য এখন রেমিট্যান্স খাতে ১১০ টাকা দেয়া হয়। কিন্তু রফতানিতে দেয়া হয় ১০৬ টাকা। তার পরও রেমিট্যান্স পাঠানোর হার কমছে। কেন কমছে আমরা জানি না। আগে আমরা ভাবতাম ডলারের বিপরীতে কম টাকা পায় বলে পাঠায় না। এখন দেখছি, এটাও উল্টোটা হচ্ছে। রেমিট্যান্স আসার হার কেন বাড়ছে না তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এর জন্য পর্যাপ্ত গবেষণার প্রয়োজন।’
ঋণের আকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে ঋণ নেয়া নিয়ে আমরা এখনো স্বস্তির জায়গায় আছি। এভাবে পুশ করতে থাকলে হয়তো আমরা একসময় অস্বস্তিকর জায়গায় চলে যাব। আমাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১৪ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ২১ শতাংশ। সে হিসেবে মোট ঋণের পরিমাণ ৩৫ শতাংশ। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ১১৭ শতাংশ, জাপানের ২০০ শতাংশেরও বেশি। আমরা এর সঠিক ব্যয় করতে পারি না। তারা সঠিক ব্যয় করে, বিনিয়োগ করে। আমরা এর ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা করতে পারলে তা কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না।’
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ‘বাংলাদেশে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষ যে পরিমাণ অপচয় করে, সেই অপচয়কে সঞ্চয় করে দরিদ্র শ্রেণীর অর্ধেক মানুষের চাহিদা মেটানো সম্ভব। কিন্তু উচ্চবিত্তদের এ বিষয়ে আমরা বোঝাতে পারিনি। সরকার বিভিন্নভাবে মধ্যবিত্তসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে সহযোগিতা করছে। কারো কারো ক্ষেত্রে এ পরিমাণ হয়তো বা কম, তবে নিয়মিত অর্থ বাড়ছে। দেশ ধীরে ধীরে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ায় সামাজিক সুরক্ষা খাতে ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ছে না।’
এ অধিবেশনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইউএনডিপির অ্যাসিস্ট্যান্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ আনোয়ারুল হক বলেন, ‘সরকারের খানা জরিপে উঠে এসেছে যে অসমতা বাড়ছে, দরিদ্রতাও বাড়ছে। এজন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিকে কীভাবে আরো বেগবান করা করা যায়, এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পকে আরো স্ট্রিমলাইন করা দরকার। শহরে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া গ্রামীণ পর্যায়ে সামাজিক সুরক্ষার আওতা যতটা শক্তিশালী তার তুলনায় শহরে সামাজিক সুরক্ষার কৌশলে দুর্বলতা রয়েছে।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা-বিষয়ক প্রোগ্রাম ম্যানেজার মার্গারিটা ক্যাপালবি বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ সরকারকে বাজেট সহায়তা দেয়। তার মধ্যে মা ও শিশু ভাতা দেয়া হচ্ছে। আগামী বছর এ বরাদ্দ আরো ২০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা শুধু সরকারের মাধ্যমে কাজ করছি না। আমরা অনেক প্রকল্পে কাজ করছি।’
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে ডিবিএমের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার মোস্তফা বলেন, ‘বৈশ্বিক সংকটের কারণে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। অনেকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কাজ কমেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট বা ডলারের মূল্যবৃদ্ধি আমাদের দেশের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে জরুরি কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
‘অর্থনৈতিক সংকটের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষও দিশেহারা। এজন্য অধিকারভিত্তিক সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কাঠামো তৈরি করতে হবে। যাতে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করা যায়’—বলেন ডিবিএমের সিনিয়র গবেষক মো. শহীদুল্লাহ।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ‘সরকারের সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। যেই একটা ঘূর্ণিঝড় হয় উপকূলীয় এলাকায় রাস্তাঘাট ভেঙে যায়। তখন মন্ত্রীরা বলতে থাকেন, আমাদের ৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট আছে। সে বাজেটের হিসাব ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেখা গেল না। এ বাজেট খরচ করবে কে?’
বেলা দেড়টায় শুরু হয় বাজেট আলোচনার দ্বিতীয় অধিবেশন। সবুজ অর্থনীতির গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বলেন, ‘তিন বছর আগে আমাদের স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে একটা সুপারিশ ছিল, আমাদের একটা গ্রিন বাজেট আমরা করতে পারি কিনা। মুহিত সাহেবের সময় একবার ডিস্ট্রিক্ট বাজেট করেছিলেন তিনি। আবার উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট বাজেট করেছেন। সে সূত্র ধরে আমরা বলেছিলাম একটা গ্রিন বাজেট করা যায় কিনা। সামগ্রিকভাবে আমার চিন্তাটা যদি গ্রিন না হয়, আমার আন্তরিকতা যদি না থাকে, এ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন প্রস্তাব দিয়ে কিন্তু আমরা ওই জায়গায় যেতে পারব না।’
আলোচনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, ‘বাজেটে আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু চাওয়া পাওয়া আছে। আমরা মনে করি, সবুজ অর্থনীতির দিকেই যেন বাংলাদেশ ধাবিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের পরে আমরা কী দেখছি? আমরা কি সূর্যের তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি? আপনি যখন হেলথ সেক্টর নিয়ে বাজেটে কথা বলবেন, তখন প্রাইমারি হেলথ কেয়ারসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে একটি গোষ্ঠীর ওপর, নারীর ওপর, শিশুর ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে সেটা কিন্তু বাজেটে নিয়ে আসতে হবে। বৃষ্টি না হলে, পানি না পেলে, তাপমাত্রা বাড়লে স্বাস্থ্যগত যে সমস্যা হবে সেটা কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসির পরিচালক এবং গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলনের সহসভাপতি ড. কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘এই যে বাজেট নিয়ে এক যুগ ধরে আমরা কাজ করছি, আলোচনা করছি এটা আসলে তরুণদের কণ্ঠস্বর কীভাবে আমরা নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি, তার একটা চেষ্টা হচ্ছে গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলন। অথবা আমরা যেটা করতে চাচ্ছি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টন প্রক্রিয়ায় তরুণদের যুক্ত করতে চাচ্ছি।’
ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশের আহ্বায়ক নাহিম রাজ্জাক এমপি গ্রিন ইকোনমি নিয়ে বলেন, ‘আমরা যদি গ্রিন ইকোনমিকে প্রমোট করতে চাই তাহলে আমাদের প্রাইভেট সেক্টরকে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ প্রাইভেট সেক্টরকে কাজে লাগালে, তাদের অনুপ্রাণিত করতে হলে এমন পলিসি গ্রহণ করতে হবে যা একাধারে দেশের ট্যাক্স বৃদ্ধি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক দিকও শক্তিশালী হবে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে ২০১৫ সালে অনুরোধ করায় তিনি প্রায় ৩০০ কোটি টাকা নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য রেখেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে সংসদে পাস হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এ ৩০০ কোটি টাকার একটি টাকাও ব্যবহার হয়নি। কোন খাতে এ টাকা ব্যয় হবে এর কারণ আমলারা বের করতে পারেননি। আমাদের অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে আমরা এটি বিনিয়োগ করতে পারি।’
ব্রাইট গ্রিন এনার্জি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান দীপাল বড়ুয়া বলেন, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। আমার মনে হয় এ নিয়ে পলিসি মেকারদের মাইন্ডসেট কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। দেড়-দুই বছরের মধ্যে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রুফটপ এবং অন্যান্য উৎস থেকে আসা সম্ভব। এখানে পাওয়ার ডিভিশন আছে, এনার্জি ডিভিশন আছে, একটা নবায়নযোগ্য জ্বালানি ডিভিশন করা দরকার। বিদ্যুৎ সংকটের এ সময়ে দেড়-দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, দুই হাজার মেগাওয়াট যদি ছাদের মধ্যে সোলার এনার্জি করা যায়, দিনের বেলায় ৫-৬ ঘণ্টা ডিজেল বা জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ না চালিয়ে সন্ধ্যায় চালালে ইকোনমিতে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
দ্বিতীয় অধিবেশনের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে দি আর্থ ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. মোসলেহ উদ্দিন সূচক বলেন, ‘আমরা একটা জাতীয় যুব প্লাটফর্ম তৈরি করেছি। যে প্লাটফর্ম ধরে আমরা দেশব্যাপী ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৫টি যুব সংগঠনকে এর সঙ্গে যুক্ত করেছি। যার মধ্যে পাঁচটি যুব সংগঠন এরই মধ্যে এর অংশীদার হিসেবে রয়েছে। ১০০ জন যুবককে এ প্লাটফর্মের মাধ্যমে আমরা বায়ুদূষণ ও নবায়নযোগ্য শক্তি এবং অ্যাডভোকেসি ক্যাম্পেইন পরিচালনা-বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমরা দেশব্যাপী এক হাজার যুব প্রতিনিধিকে বায়ুদূষণ ও নবায়নযোগ্য শক্তির প্রচরণা অভিযানের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছি। এ প্লাটফর্ম নবায়নযোগ্য শক্তির ভবিষ্যৎ ও সবুজ রূপান্তরে যুব সম্প্রদায়ের ভূমিকা নিয়ে অ্যাডভোকেসি করি। আমরা পরিকল্পনা করেছি, যুবকরা মিলে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি পাঠাব—কীভাবে নবায়নযোগ্য শক্তিকে জাতীয় নীতিতে আরো ফোকাস করা যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু সোনালি অর্জন রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ১৯৯৬ সালের পোলট্রি বিপ্লব। যার অন্যতম হাতিয়ার ছিল প্রশিক্ষণ। এরপর ২০০০ সালের দিকে তথ্যপ্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলে এবং বেসরকারিভাবে এসব কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়। ঢালাও অনুমোদন দেয়ায় কর্মসংস্থান ব্যাংক হয়েছে। সেই ব্যাংক থেকে যুব উদ্যোক্তারা ঋণ নিয়ে নিজের ও পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। অতীতের এসব অর্জন থেকে আমাদের দাবি সবুজ রূপান্তরের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। এছাড়া করসীমা নির্ধারণ করতে হবে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশের আহ্বায়ক নাহিম রাজ্জাক বলেন, ‘সব জিনিসকে প্রমোট করতে প্রণোদনা প্রয়োজন। কারণ প্রাইভেট সেক্টরকে যদি অনুপ্রাণিত করতে হয় তাহলে তাদের কর মওকুফ এবং অন্যান্য আর্থিক সাপোর্ট দিতে হবে। আমি মনে করি, গ্রিন ইকোনমি পলিসি থাকা উচিত। গত এক যুগে আমরা দেখেছি প্রত্যেকটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যে এসডিজিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান, ডেল্টা প্ল্যান রয়েছে। প্রত্যেকটি পরিকল্পনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স এবং স্টাডিকে কেন্দ্র করে সব ব্যবস্থা নেয়ার নীতিমালা রয়েছে। গ্রিন ইকোনমি প্রমোট করতে ফাইন্যান্সিং একটা প্রধান চ্যালেঞ্জ।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও গ্রিন গ্রোথের কথা বলছি। আমরা আসলে কতটুকু সিরিয়াস? পলিসি মেকাররা কতটুকু সিরিয়াস? পলিসি মেকারকে প্রথমে ধরব, তারপর প্রাইভেট সেক্টরে যারা আছেন তাদের এবং আমরা যারা গবেষণা করি আমাদেরও অবশ্য দায় আছে। আমাদের সমালোচনা এমনই হবে যে আমরা ভালো করছি না। বিভিন্ন দেশের এনার্জি মিক্সে যে চিত্রটা দেখা গেছে, সেখানে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি নবায়নযোগ্য শক্তিতে। আমাদের গতি অনেক স্লো।’
তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, আমরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সিরিয়াস না। কেন সিরিয়াস না? সেই জায়গায় তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নবায়নযোগ্য শক্তিতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার সে জায়গায় আমরা যথেষ্ট পিছিয়ে আছি। যেভাবে বিনিয়োগ করা উচিত সেভাবে আমরা বিনিয়োগ করতে পারছি না। পলিসি লেভেলে বেশ কয়েকটি নতুন পলিসি এসেছে এটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু সমস্যা হলো বাস্তবায়নে গিয়ে বড় ঘাটতি দেখা দেয়। এ সমস্যাটা অর্থনীতির বিভিন্ন খাতেই পরিলক্ষিত। আমাদের ইকোনমিক ও সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের জন্য এনার্জির ট্রানজিশন দরকার। রাজনৈতিক অর্থনীতি এখনো আমাদের ট্রানজেকশনের জন্য যথেষ্ট সহায়ক না।’
ক্লিনের প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদি বলেন, ‘পৃথিবীর ১৮০টা দেশের মধ্যে এখন পরিবেশের জায়গা থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম। গত পরশুদিনের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেরে দূষিত শহরগুলো দেখি তাহলে ঢাকার অবস্থান তৃতীয়, দ্বিতীয় অবস্থান কলকাতা এবং প্রথম অবস্থানে সানটিয়াগো রয়েছে, যার অধিকাংশ দেশই উন্নয়নশীল দেশ। আমরা পরিবেশের ভারসাম্য বিবেচনায় না নিয়ে প্রতি ১০০ টাকা ইনকাম করতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করি ৪৭০ টাকার। আমরা কয়লা ও তরল জ্বালানি দিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি তাতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে করতে গিয়ে স্বাস্থ্য এবং জীবন-জীবিকার খাতে যে দীর্ঘমেয়াদি খরচ হয়ে যায় তার পরিমাণ ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৩০ পয়সা খরচ হয়ে যায়। সেটা আমরা টাকার অংকে ধরি না, কিন্তু সামাজিক বা ব্যক্তিগতভাবে আমরা খরচটা বহন করি। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৬৩৭ গ্রাম কার্বন নিঃসরণ হয়। যার দাম এখন আমাদের দেশের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ১ টাকা ৩৭ পয়সা। তার মানে সব মিলিয়ে আমরা মোটামুটি ৩ টাকা ৬৮ পয়সা ক্ষতির শিকার হই এক ইউনিট ফসিল বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে। মূলত নয়টা খাতকে জরুরিভাবে সবুজায়ন করার কথা বলা হয়। এগুলো হলো জ্বালানি, পরিবহন, শিল্পায়ন, অবকাঠামো, কৃষি, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা ও পর্যটন। এ নয়টা খাতকে বলা হয় যে জরুরিভাবে সবুজায়ন করার জন্য। এখানে দুটি জিনিস মেনে চলার জন্য বলা হয়। সবচেয়ে কম সম্পদ ব্যবহার, সবচেয়ে কম নিঃসরণ এবং সবচেয়ে কম দূষণ করে কীভাবে সবচেয়ে বেশি কল্যাণ সাধন করা যায়।’
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ব্যবস্থাপক আজাদ আবুল কালাম বলেন, ‘বহির্বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপরে বিনিয়োগ কমছে, তবে বাড়ছে গ্রিন ইকোনমিতে। ভারত, চীনসহ সব দেশেই গ্রিন ইকোনমি বাড়ছে। বহির্বিশ্বের এ বিষয়গুলো বাংলাদেশের আমলে নিয়ে বিনিয়োগের জায়গাগুলো শনাক্ত করা প্রয়োজন। আমাদের বাজেটে গ্রিন ইকোনমি থেকেও জীবাশ্ম জ্বালানিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। জ্বালানি বাজেটে পাওয়ার জেনারেশনে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, যার ৯৭ শতাংশই জীবাশ্ম জ্বালানিতেই। তবে তুলনামূলকভাবে এর পরিধি কমছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯৫ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানিতে। এর বিপরীতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ হয়েছে ৫ শতাংশ। যদি গ্রিন ইকোনমি আনতে চাই তাহলে এ জায়গায় আমাদের বিস্তর পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশের এনার্জি ক্যাপাসিটি ২০২৭ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর বিপরীতে ২০২৭ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি তিন হাজার মেগাওয়াট হবে। তাই তূলনামূলকভাবে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছি, যা আমাদের গ্রিন ইকোনমিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের পাশাপাশি বাড়ছে নবায়নযোগ্য কর্মসংস্থান। চীন ও ইন্ডিয়ায় জীবাশ্ম জালানির তুলনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বেশি। কর্মসংস্থান কমছে জীবাশ্ম জ্বালানিতে। আমাদের গ্রিন ইকোনমির জন্য কোনো জাতীয় নীতিমালা নেই। নেই কোনো জাতীয় এনার্জি পলিসিও। আমি মনে করি, এনার্জি সেন্টারকে পরিচালনা করার জন্য এটা একটা দলিল হিসেবে কাজ করবে। আমরা কোথায় কতটুকু কীভবে এ গ্রিন এনার্জি ব্যবহার করব, যা আমাদের এ সেক্টর পরিচালনার কাজকে সহজ করবে। তাই সরকারের এ সেক্টরে দ্রুত মনোযোগ দেয়া দরকার। বাজেটে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তা না হলে এনার্জি সেক্টরে তেমন কোনো পরিবর্তনই আনা সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো যেমন অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন প্রকল্প, রূপকল্প ২০৪১, ডেল্টা প্ল্যানের মতো বড় পরিকল্পনাগুলোয় গ্রিন ইকোনমিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যে সেক্টরগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেশি সেই খাতে গ্রিন এনার্জি ব্যবহারে মনোযোগ দিতে হবে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে রেডিমেড গার্মেন্ট সেক্টরগুলো।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইভি সার্জিং স্টেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটার জন্য ২০২২ সালে একটা নির্দেশিকা করা হয়েছিল। এ নির্দেশিকায় এ খাতকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে বেশি। এটাকে আটকে দিতে চাচ্ছে বেশি। সে কারণে দুটো জায়গায় আমাদের দেখা দরকার। চার্জিং স্টেশনের কর মওকুফ করা সম্ভব কিনা সেটা প্রথমে দেখা দরকার। তারপর ইভি খাত আমদানি শুল্ক, রেজিস্ট্রেশন, নবায়ন ইত্যাদি খাতে আমরা টাকা না নিতে পারি। কারণ এটা নতুন খাত। এ খাত থেকে কর না নিলে কোনো ক্ষতি হবে না। পুরনো খাত থেকে টাকা নিতে পারি। শিল্প খাতের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ, কৃষি ১২ দশমিক ৪১ শতাংশ নিঃসরণ করে, পরিবহন ৯ দশমিক ৯২, সিমেন্ট, সার কারখানা ৩ দশমিক ৩২ ও ইস্পাত ১ দশমিক ৯ শতাংশ, এগুলো হলো মূল দূষণকারী খাত। এর বাইরে চামড়া খাত আছে। এ দূষণকারী খাতের ওপর এখন দুনিয়াব্যাপী এখন সবুজ কর, কার্বন কর আরোপ করা হচ্ছে। এটা আরোপ করার সময় খেয়াল রাখতে হচ্ছে যে আমার পণ্যের দাম বেড়ে না যায়। এটা করপোরেট রেটে করতে হবে।’
স্বাগত বক্তব্যে ডিবিএমের নির্বাহী কমিটির সদস্য জাকিয়া শিশির বলেন, ‘বিশ্বে গ্রিন ইকোনমি নিয়ে নানা আলোচনা নানা কথাবার্তা চলছে। গ্রিন ইকোনমির গুরুত্ব অনেক বেশি। এক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করছি। এক দশক ধরে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় কনসেন্ট্রেশনের মাধ্যমে জনগণের যে চাহিদাগুলো আছে, সেগুলোর নীতিনির্ধারণে কাজ করি। প্রত্যেকের মতামতকে যথাযথভাবে যথাযথ জায়গায় পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করব।’