কৃষিতে মানবসভ্যতার জাগরণ শুরু। কৃষি বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির মূল ভিত্তি। আমাদের দেশে ধান, গান ও পাখির সমৃদ্ধি রয়েছে। তাই অগ্রহায়ণে ধান কাটার উৎসব গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। পহেলা অগ্রহায়ণ বাঙালি গৃহস্থ বাড়িতে উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। নতুন ধানের গন্ধে ম ম করে উঠান-বাড়ি। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পহেলা অগ্রহায়ণ দিনটি নবান্ন উৎসব হিসেবে পালন করা হয় কৃষক পরিবারগুলোতে।
২০০৮ সালে তৎকালীন সরকার এই দিনটিকে জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এর পেছনে একটি গল্প রয়েছে। ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের সরবরাহ হঠাৎ কমে যায় এবং বাংলাদেশ অর্থ দিয়েও চাল কিনতে পারছিল না। প্রতিবেশী দেশ ভারত রপ্তানির আশ্বাস দিলেও পরে তা বাস্তবায়ন করেনি, তখন সরকার কৃষিতে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।
মাছে-ভাতে বাঙালির খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষির গুরুত্ব আর উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তাই ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পহেলা অগ্রহায়ণকে জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং সারাদেশে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে। ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই দিবস পালিত হচ্ছে।
নবান্ন একটি ঋতুকেন্দ্রিক উৎসব, যার অর্থ “নতুন অন্ন”। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়, যা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত হয়। হাজার বছরের পুরোনো এই উৎসব অসাম্প্রদায়িক এবং ঐতিহ্যবাহী।
বাংলাদেশে নবান্ন উৎসব পালিত হয় আমন ধানের ফলন ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করে। আমন শব্দটি আরবি “আমান” থেকে এসেছে, যার অর্থ আমানত; অর্থাৎ এটি কৃষকের কাছে একটি নিশ্চিত ফসল হিসেবে পরিচিত ছিল। এ কারণে এ মৌসুমকে কেন্দ্র করে পালিত হয় নবান্ন উৎসব।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নবান্ন উৎসব পালিত হয়, যেমন উত্তর-পশ্চিম ভারতের ওয়াজিরাবাদে বৈশাখ মাসে গম ঘরে তোলার আনন্দে নবান্ন পালন করা হয়। সাঁওতালরা পৌষ-মাঘ মাসে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে সোহরায় উৎসব উদযাপন করে।
বাংলার মুসলিম কৃষক সমাজ অগ্রহায়ণের প্রথম শুক্রবার থেকে নবান্ন উৎসব শুরু করে, আর সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষকরা ১ অগ্রহায়ণ থেকে এটি পালন করেন। দেশের পাহাড়ি জনপদেও নতুন ধানের নবান্ন উৎসব চলে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষক দিবস পালিত হয়ে আসছে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়াতে প্রতিবছর তিনদিনব্যাপী কৃষি দিবস উদযাপন করা হয়।
কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নবান্নের আনন্দ ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন, “অশ্বত্থ পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে...” এবং “চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল।” জাতীয় কৃষি দিবসের প্রধান আকর্ষণ হলো নতুন ধান কাটার উৎসব বা নবান্ন।
কৃষক-কৃষাণীরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নবান্নের আনন্দ ভাগাভাগি করেন এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়ির জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়।
নবান্ন উৎসবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের পুরস্কৃত করা হয় এবং কৃষি মেলার আয়োজন করা হয়।
রাজধানীতে শাহবাগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর নবান্ন উৎসব উদযাপন করা হয়, যেখানে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, সংগীত, নৃত্য ও পিঠা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
নবান্ন উৎসবে গ্রামীণ মেলায় নানা ধরনের দোকান বসে, যেখানে পিঠা, মিষ্টি ও খেলনা পাওয়া যায়। বাউল গানের আসরও বসে।
উপসংহারে, জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের দাবিগুলো আজও গুরুত্বপূর্ণ; কৃষক যেন তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় এবং জমিতে তার কায়েমি স্বত্ব বজায় থাকে।