agribarta

ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পরিত্রাণ পেতে জলাভূমি ও সবুজ পরিধি বাড়াতে হবে


কৃষি

বণিক বার্তা

(৩ দিন আগে) ২২ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ৯:৫৯ পূর্বাহ্ন

agribarta

দেশে ‍উষ্ণতম মাস এপ্রিল। প্রতি বছরই এ মাসে তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। তবে বৈশাখের ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টি তাপের তীব্রতা কমিয়েও আনে। কিন্তু এ বছর এপ্রিলের শুরু থেকেই বেড়েছে দাবদাহ। একই সঙ্গে বেড়েছে আর্দ্রতাও। ফলে আবহাওয়া পৌঁছেছে অসহনীয় পর্যায়ে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এরই মধ্যে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি অতিক্রম করে গেছে। অধিকাংশ স্থানে বাতাসের আর্দ্রতাও ৫০ শতাংশের বেশি। 

অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও তাপপ্রবাহ দীর্ঘ সময়জুড়ে চলমান থাকলে দেখা দিতে পারে সংক্রামক-অসংক্রামক নানা ব্যাধি। ৪০ ডিগ্রির ওপরের এ তাপমাত্রা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। কেননা আর্দ্রতা, বিকিরণ ও বাতাসের গতিপ্রকৃতি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে মানবদেহে তাপমাত্রার নেতিবাচক প্রভাবগুলোকে বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোয় হিট স্ট্রোকে মৃত্যুর প্রবণতাও বিশ্বের অন্যান্য অংশের চেয়ে তুলনামূলক বেশি।

২০৪১ সালে দেশকে উন্নত রাষ্ট্রের লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। এটা অনেকাংশে নির্ভর করবে মানুষের কর্মক্ষমতা বা উৎপাদনশীলতার ওপর। এদিকে কয়েক বছর ধরে এপ্রিলে তাপপ্রবাহের মাত্রা বেড়েই চলছে। এমনকি দেশের ঋতুভিত্তিক আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আবহাওয়ার এমন অবনতি অব্যাহত থাকলে দেশের মানুষের কর্মক্ষমতা কমবে, ক্ষতির সম্মুখীন হবে উৎপাদন ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাহত হবে, বেড়ে যাবে স্বাস্থ্য ব্যয়। কাজেই তাপমাত্রা সহনীয় রাখা জরুরি। এজন্য জলাভূমি ও সবুজের পরিধি বাড়ানোর বিকল্প নেই। সবুজ অর্থনীতির দিকে আমাদের ধাবিত হতে হবে।

উষ্ণায়ন বৃদ্ধি বর্তমানে একটি অন্যতম বৈশ্বিক সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবেলায় বিশ্বের অনেক শহরের নগর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করছে। কানাডার টরন্টোয় প্রতিরোধমূলক ও প্রতিক্রিয়ামূলক উভয় ধরনের পদক্ষেপই রয়েছে। প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে নগর কর্তৃপক্ষ শহরে স্বাস্থ্যসম্মত সবুজ পরিসর বাড়িয়েছে। যেসব এলাকায় সবুজের ঘাটতি আছে সেখানে গাছপালা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বিদ্যমান জলাভূমি সংরক্ষণ করেছে এবং নতুন জলাধার তৈরি করেছে। নগর উদ্যান বাড়ানোর পাশাপাশি গ্রিন রুফ ও গ্রিন ওয়ালের ব্যবহার বাড়িয়েছে। 

পরিবেশকে মাথায় রেখে নগর পরিকল্পনা ও ভবনের নকশায় এনেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। আর প্রতিক্রিয়ামূলক পদক্ষেপ হিসেবে একটি সুসমন্বিত হিট রেসপন্স প্ল্যানের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। নিয়মিতভাবে তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। হটস্পট চিহ্নিত হচ্ছে। একই সঙ্গে নাজুক জনগোষ্ঠীকে দ্রুত সেবা দিতে নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোকে ঢেলে সাজিয়েছে। 

সর্বোপরি জ্বালানির ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে সেখানে বিভিন্ন ধরনের পিক-সেভিং ম্যাকানিজম, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবস্থাসহ অন্য কিছু উদ্ভাবনমূলক কৌশল নেয়া হয়েছে। স্পেনের বার্সেলোনা, ব্রাজিলের সাও পাওলো, গ্রিসের এথেন্স, নেদারল্যান্ডসের লিসে, টোকিও, লন্ডনসহ বিশ্বের আরো কিছু শহরেও টরন্টোর মতো উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে অভিযোজনে নানা ধরনের প্রতিরোধমূলক ও প্রতিক্রিয়াধর্মী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের সময় এখন আমাদেরও।

অসহনীয় গরমে প্রকৃতির ক্ষতি হচ্ছে ও মানুষের জীবনীশক্তি কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই কমছে কাজের স্পৃহা। একজন মানুষ সুস্থ ও স্বাভাবিক শরীর বা মন নিয়ে যে পরিমাণ কাজ করতে পারে, অসুস্থ শরীর বা মন নিয়ে তার পক্ষে সেই পরিমাণ কাজ করা সম্ভব নয়। আবার উষ্ণায়নে মানুষ স্থায়ীভাবেই কর্মক্ষমতা হারাতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। জরুরি ভিত্তিতে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ও প্রতিক্রিয়ামূলক উভয় ধরনের পদক্ষেপই নিতে হবে।

ইট-পাথরের আচ্ছাদন নয়; সবুজের বিপুল সমাবেশ ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে নিয়মিত তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। তাপমাত্রার হটস্পটগুলো কী, কেন সেখানে তাপমাত্রা বেশি থাকছে, তার কারণ চিহ্নিত করতে হবে। হিট ওয়াচ মনিটরিং বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয় তাপমাত্রাজনিত অসুস্থতার চিকিৎসা ও সেবা সুবিধাও বাড়াতে হবে, যাতে এ ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলা করা সহজ হয়।

পরিবেশগত সূচকে দেশের অবস্থার অবনতি হচ্ছে দিনকে দিন। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য বাংলাদেশ কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট অ্যানালাইসিস (সিইএ)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের ফলে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু বায়ুদূষণে ৫৫ শতাংশের মৃত্যু হচ্ছে। পাশাপাশি অনিরাপদ পানি, নিম্নমানের স্যানিটেশন ও হাইজিন এবং সিসা দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। 

২০১৯ সালে পরিবেশ দূষণের ফলে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এতে বায়ুদূষণের অবদান ছিল ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে মানুষ বায়ুদূষণের কারণে। অথচ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য পরিবেশগত উপাদান হলো বিশুদ্ধ বায়ু।

পরিবেশ দূষণে ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে দেশ। উচ্চ তাপমাত্রা নতুন সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ সংকট মোকাবেলায় নগর পরিকল্পনা ও ভবনের নকশায় আনতে হবে পরিবর্তন। গ্রহণ করতে হবে পরিবেশবান্ধব ও সবুজায়নের উদ্যোগ। রোধ করতে হবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে পুকুর থেকে শুরু করে মাঠ সব হারিয়ে যাচ্ছে। ফুটপাত-রাস্তা বেদখল হচ্ছে, খাল, নদীনালা, নর্দমা জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে একদিকে সংকুচিত হয়েছে, অন্যদিকে অব্যবস্থাপনায় দূষিত হয়েছে। শহরগুলোয় যত্রতত্র ভবন গড়ে উঠেছে। না নিরাপদ, না স্বাস্থ্যসম্মত।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে ঢাকা শহরের ৬৫ শতাংশ কংক্রিট বা অবকাঠামোয় আচ্ছাদিত ছিল। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় প্রায় ৮২ শতাংশ। এ সময়ে জলাশয় ও খোলা জায়গা প্রায় ১৪ থেকে কমে ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে। যে কারণে ঢাকার তাপমাত্রা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি থাকছে। ঢাকা শহরের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখানে তীব্র গরম হওয়ার কথা ছিল না। এখন ঢাকায় তাপমাত্রা কমাতে ব্যবহৃত হচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। আর বাইরের তাপমাত্রা আরো বাড়ছে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমনে।

একটি দেশে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নিম্নে ২৫ ভাগ বনভূমি ও ১৫ ভাগ জলাশয় থাকা দরকার, যা আমাদের দেশে এখন নেই। পর্যাপ্ত জলাশয় ও সবুজ পরিসরের জন্য এখন কাজ করা সময়ের দাবি। হারানো সবুজ কিংবা জলাধার কোনোটাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে অবশিষ্ট যা আছে, সেগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে, দূষণ মুক্ত করতে হবে। 

নির্মিত ভবনগুলোয় ছাদবাগান করায় উদ্যোগী হওয়া জরুরি। দেশের মাটিকে দূষণমুক্ত করে গাছপালা জন্মানোর উপযোগী করা প্রয়োজন। বিশেষ করে ঢাকার মাটির গুণাগুণ একদম তলানিতে। দেশেও আবাদি জমির পুষ্টিগুণ কমছে। পরিবেশ দূষণ রোধে সবাই সচেষ্ট হলে জলবায়ুজনিত এ বিপর্যয় মোকাবেলা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। তবে সবকিছুই করতে হবে সুপরিকল্পিতভাবে। পরিকল্পনাবিদ, স্বাস্থ্য ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততায় দেশকে বাসযোগ্যতার উন্নয়নে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করতে হবে।