agribarta

ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরের রাশি রাশি ধানে কৃষকের হাসি


কৃষি

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর

(৪ ঘন্টা আগে) ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ৯:৪৫ পূর্বাহ্ন

agribarta

নেত্রকোণার হাওরজুড়ে ধান আর ধান; বাতাসে দুলছে পাকা ধানের সোনালি শীষ। দাবদাহের মাঝেও ছেলে-বুড়ো, নারী সবাই ধান কাটা আর মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

এ বছর ধানের ফলন ও দাম ভাল থাকায় ‘দাওয়ামারির’ রং ছড়িয়ে হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। ফলন ভাল হওয়ায় এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছে কৃষি বিভাগ।

আশা করা যাচ্ছে, শেষ মুহূর্তে উজানের ঢলের মতো দুর্যোগের কবলে না পড়লে হাওরের পুরো ধান গোলায় তুলে লাভবান হবেন কৃষক।

মদন উপজেলার উচিৎপুর গ্রামের কৃষক নাজমুল হাসান নাজিম কয়ার হাওরে বোরো ধান চাষ করেছেন। বললেন, “এইবার ভালো ফসল অইছে। ধান কাটা লাগছে যেবায়, রোইদ দিছে; সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আমরার ধান কইট্যা ফালায়াম। ফসলও ঘরে তুইল্যা ফালাইয়াম।

“ধানের রেইটও (মূল্য) ভাল। ভিজা ধান ক্ষেত থেইক্যাই ৮৫০ থেকে ৮৬০ টাকা মণ দরে নিতাছেগা বেপারিরা। আমরার কেরিং (যোগাযোগ ও পরিবহন) খরচও নাই। আমরা খুশি।”

নেত্রকোণা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জেলার হাওরাঞ্চল, সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চল মিলিয়ে প্রায় ৫ লাখ ৩০ হাজার কৃষক মোট ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করেছেন।

এর মধ্যে জেলার মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী ছাড়াও কলমাকান্দা, আটপাড়া ও বারহাট্টার একাংশ নিয়ে হাওরাঞ্চলের ৪১ হাজার ৭০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কৃষক আবাদ করেছেন।

এখন হাওরে চলছে বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। হাওরজুড়ে আগাম উফশি-৮৮, ৮৯, ৯২ ও হাইব্রিড জাতের ধান পাকায় কৃষকরা আনন্দের সঙ্গে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মনের আনন্দে তারা ধান শুকিয়ে গোলায় তুলছেন।

জেলায় এ বছর ১২ লাখ ৩ হাজার ৯০০ মেট্রিকটন ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে হাওরে উৎপাদন ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন। হাওরে ৬১৩টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার মেশিন ধান কাটায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে কৃষকের খরচ যেমন কম হচ্ছে, তেমনি শ্রমিক নিয়েও সংকট নেই।

কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকরা বলছেন, অনুকূল আবহাওয়া, বীজ, সার, সেচ- সবই প্রয়োজন মতো সঠিক সময়ে পাওয়ায় হাওরজুড়ে এবার বোরো ধানের উফশি ও হাইব্রিড জাতের অভাবনীয় ফলন হয়েছে। চারদিকে ধান আর ধান। হাইব্রিড আর উফশি মিলিয়ে গড়ে একরে ৮০ মণ ধান ফলন হচ্ছে।

নেত্রকোণা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, “হাওরে ৫৬০টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও ৫৩টি রিপার মেশিন এবং ১২০০ কৃষি শ্রমিক দিয়ে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে। এবার শ্রমিক সংকট নেই। কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিনে খুব দ্রুত সময়ে ধান কাটাসহ ধানের ফলন ও দাম ভাল হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।

“হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় একদিকে জমি থেকে ধান পরিবহন খরচ কম হচ্ছে কৃষকের, অপরদিকে হাওর থেকে সরাসরি ট্রাকে করে সেই ধান যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন মোকামে। এ অবস্থায় কৃষকরা দামও পাচ্ছেন আশানুরূপ।”

তিনি বলেন, “ব্যবসায়ীরা মাঠ থেকেই প্রকারভেদে ৮৪০ থেকে সাড়ে ৯০০ টাকা দরে কিনে নিচ্ছেন ভেজা ধান। হাওরে এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন ধান। তবে ফলন ভাল হওয়ায় আশা করছি, লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আরও ৩০ হাজার মেট্রিকটন ধান বেশি উৎপাদন হবে।”

৩০ এপ্রিলের মধ্যে হাওরের ধান কাটা শেষ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে জানিয়ে এ কৃষি কর্মকর্তা বলেন, “একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ঘণ্টায় এক একর এবং একটি রিপার মেশিন দিয়ে ঘণ্টায় ৩৩ শতাংশ জমির ধান কাটা যায়। বর্তমানে প্রতিদিন সাড়ে ৩ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ ধান কাটা হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিনই ধান কাটার হার বাড়বে।

“রোববার নাগাদ হাওরে ২৫ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। জেলার সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলেও বোরো ধানের আগাম জাত কিছু কিছু জমিতে পাকায়, সেখানে কাটা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে জেলায় সব মিলিয়ে আট শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। পুরো জেলায় মাঠে মোট ৮৫০টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার মেশিন সচল রয়েছে।”

যন্ত্রের মাধ্যমে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ করায় কৃষকের খরচ কেমন পড়ছে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, “কৃষি শ্রমিকের মাধ্যমে হাতে ধান কাটলে একর প্রতি খরচ হয় ন্যূনতম ১৫ হাজার টাকা। আর কম্বাইন্ড হারভেস্টারে ধান কাটায় কৃষকের ১০ হাজার কমে খরচ পড়ছে ৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া হাওরে সেচসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে মোট খরচ হয়েছে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা। খরচ কম হওয়ার পাশাপাশি ফলন ভাল হওয়ায় কৃষকেরা খুশিতে আছেন।”

জেলার কৃষি বিভাগের এই শীর্ষ কর্মকর্তা ধান ৮০ শতাংশ পাকলেই কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষকদের। বলেন, “ধানের শীষের উপরের দিক থেকে ৫ ভাগের ৪ ভাগ পাকলেই তা ৮০ শতাংশ পাকা হয়েছে বুঝতে হবে এবং সেই ধান কাটার জন্য শতভাগ উপযোগী।”

মদন উপজেলার উচিৎপুর গ্রামের কৃষক মঞ্জুর আলী এবার কয়ার হাওরে ৬২ কাঠা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। রোববার তিনি বলেন, “আজকে প্রথম ৮৮ ধান কাটতাছি। কাঠাপ্রতি সাড়ে ছয় থেকে সাত মণ টিকতাছে। চিকন ধান তো তাই; নাইলে আট থেকে ১০ মণ টিকতো।

আবহাওয়া এবার ভালো গেছে বলে মনও ভালো এ কৃষকের। বলছিলেন, “আবহাওয়াডার কারণে আমাদের ফসল উন্নতমানের অইছে। কোনো কোনো কৃষকের হাইব্রিড ১০ মণ থেকে ১২ মণও অইতাছে। খুবই খুশি আছি। বাকি যে সময়ডা আছে, ধানডা যদি বেকডা কাটতাম পারি তাইলে আমরা লাভবান হইয়াম। অনেকেই চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে ধান কাটা শুরু করছে।”

একই গ্রামের কৃষক নাজমুল হাসান নাজিম বলেন, “আগে কামলা দিয়া জমি কাটাইতে প্রায় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা লাগত। এখন ধান কাটার মেশিন থাহনে কৃষকরার আয় হইছে। কাটাপ্রতি ৫০০ টাকা লাগে। সবচেয়ে বড় কথা অল্প সময়ে অনেক জমি কাটানো যায়।”

একই উপজেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামের চাষি কালু মিয়া বাগুয়ার হাওরে দুই হাজার টাকা কাঠাপ্রতি জমা দিয়ে ৪৫ কাঠা জমিতে হাইব্রিড ও উফশি ধানের আবাদ করেছেন। হাইব্রিড ফলন হয়েছে কাঠাপ্রতি ১০ মণ। প্রতি কাঠায় মোট গড়ে পাঁচ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে তার। জমি থেকেই ভেজা ধান বেচে পাচ্ছেন ৮ হাজার ৩০০ টাকা।

তিনি বলেন, “কাঠাপ্রতি ৩ হাজার উপরে লাভ পাইছি। এ ছাড়া ২০ কাঠার মতো নিজের জমি আছে। ওই জমির ধানে কাঠপ্রতি গড়ে পাঁচ হাজার টাকা লাভ পাইতাছি। সপ্তাহ খানেক লাগব, পুরো জমির ধান কাটতে।”

একই গ্রামের কনক মিয়াও হাওরটিতে আবাদ করেছেন ১৬ কাঠা জমি। তিনিও ভাল ধান হওয়ার কথা জানালেন।

কনক বলেন, “এইবার হাওরের জমিতে ধান আর ধান। ক্ষেতের দিকে তাহাইলে মনডা জুড়ায়া যায়। আমার জমিও প্রায় পাইক্যা আইছে। ধানের শীষ পাকা ধানে নুইয়া পড়ছে। গত কয়েক বছর অমন ধান আর অইছে না।”

গোবিন্দ্রশ্রী গ্রামের কৃষাণী আমেনা বানু রোদের মধ্যে ধান সেদ্ধ ও শুকানোর কাজ করছিলেন। তার সঙ্গে আরও তিনজন নারী কাজ করছিলেন।

রোদে কষ্ট করে কাজ করছেন কেন? জানতে চাইলে আমেনা বানু বলেন, “আামরার তো রইদেরই দরকার। অতো গরম; এরপরেও আমরার কিন্তু আনন্দই লাগতাছে। দেহেন, মাঠের মধ্যে গ্রামের পুরুষ, নারী, শিশুরা সবাই দাওয়ামারি লইয়া ব্যস্ত। এইবার যে ধান অইছে, তা ঘরে নেয়নই আমরার চিন্তা। রইদ থাকতে থাকতে সব ধান জমি থেইক্যা নিয়াম।”

রোববার ভরদুপুরে গ্রামের সামনে মাঠে প্রখর রোদের মাঝে ঘামছিলেন আমেনা বানুর প্রতিবেশী রহিমা আক্তার। তবু যেন মনে প্রশান্তির খামতি নেই।

রহিমা বলেন, “ঈদ গেছে। নতুন বছরের পয়লা দিনডাও গেছে। এর মধ্যে ধান কাডাটাও আইছে। আমরারতো দাওয়ামারিডাও পরবের।

“একটার পরে একটা পরব লাগছে আমরার। এইবার ধান ভালা অইছে। আমরার শরীরে, মনে রঙ লাগছে। এই রঙ কী আর গরমে কমাইতে পারব। দোয়া কইরেন, সামনের কয়ডা দিন যেন ভালা যায়। ধানডা ঘরে তুলতাম পারি।”

গোবিন্দ্রশ্রী গ্রামের ধানের ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, “জমি থেইক্যা ভিজা ধান কিনতাছি। মোট ধান ৮৬০ থেকে ৮৬৫ টাকা। চিকন ধান ৯৬০ থেকে ৯৭০ টাকা। এই ধান দেশের বিভিন্ন মোকামে নিয়া যাইতাছেগা। আমি খালিয়াজুরীর বিভিন্ন হাওর থেকেও ধান কিনতাছি।”

একই গ্রামের আরেক ব্যবসায়ী শাহ আলমও মাঠ থেকে ধান কিনছেন। তিনি বলেন, “গত কয়েক বছরের মধ্যে কৃষক এমন ধানও পাইছে না, দামও পাইছে না। হাওরে অহন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালা। কৃষকের কোনো পরিবহন খরচ নাই। ক্ষেত থেইক্যা ধান আমরা কিইন্যা বিভিন্ন মোকামে বেঁচতাছি। সামনের দিনগুলো ভালা গেলেই সবারই ভালা।”