কনসার্টে গায়ক জেমস আর দর্শক হিসেবে আপনার চিত্কারের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি? দুজনই তো সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত স্বরযন্ত্র ব্যবহার করে একই প্রক্রিয়ায় সাধ্যমতো চিত্কার করছেন। তার পরও একজনের চিত্কার শোনার জন্য হাজার হাজার মানুষ অর্থ ব্যয় করে জমায়েত হয়। অন্যদিকে আপনি লাউড স্পিকারে তেমন স্বরে চিত্কার শুরু করলে লোকে দৌড়ে পালাতে শুরু করবে, তাই না?
আবার ধরুন, কিছু লোহালক্কড় ব্যবহার করে আপনাকে কিছু একটা বানাতে অনুরোধ করা হলো। আপনি সেগুলো অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করে এক জায়গায় স্তূপ করে রাখলেন। তা দেখে লোকে হয়তো ভাববে পরিত্যক্ত আবর্জনা। কিন্তু সেগুলো একজন স্থপতিকে দিলে? তিনি সেগুলো একত্র করে দৃষ্টিনন্দন এমন একটা কিছু সৃষ্টি করবেন, যার দিকে লোকজন মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকবে। সেখানে ছবি ওঠাতে গর্ব বোধ করবে, তাই না?
কেন এমনটা হয়, ভেবেছেন কখনো? এমন পার্থক্য হওয়ার কারণটা খুব সহজ। সেটা হলো, একজন সৃষ্টির গ্রামার মেনে কাজ করছেন, আরেকজন দক্ষতাহীন ও বিক্ষিপ্তভাবে। কোনো হলরুমে আনাড়ি কেউ ড্রাম বাজালে কান ফেটে যাওয়ার অবস্থা হয়। কিন্তু অভিজ্ঞ কেউ বাজাতে শুরু করলে নিজের অজান্তেই তার তালে নেচে উঠতে মন চায়!
ঠিক তেমনিভাবে আমাদের কাজগুলো গ্রামার মেনে, সৃষ্টিশীল উপায়ে করা হলে মানুষ সহজেই তার সঙ্গে একাত্ম হয়। নিজের ভেতরে তার প্রতিধ্বনি বা অনুরণন শুনতে পায়। মাঝেমধ্যে তা রিপ্রডিউসও করে। পছন্দের গানটি নিজের অজান্তেই গুনগুন করে গেয়ে ওঠার রহস্য বুঝি এখানেই।
কিন্তু জীবনের সব ক্ষেত্রে কি এমন সংযোগ ঘটে? না, বিশেষত শিক্ষার ক্ষেত্রে তা একেবারেই হয় না। তার বড় প্রমাণ হলো, আপনার স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাকে নুডলস রান্না শেখাতে চান, দেখবেন সে খুব আগ্রহ নিয়ে সেটা চেষ্টা করছে। কিন্তু যেই অংক শেখাতে বসবেন, মনটা বেজার হয়ে যায়। কেন এমনটা হয়? কারণ শিক্ষার সঙ্গে তারা বাস্তবতার কোনো যোগসূত্র খুঁজে পায় না। ফলে শৈশব থেকেই অধিকাংশের শিক্ষার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠে।
জাইন প্রায়ই ভিন্ন রকম প্রশ্ন করে। সেদিন জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা বাবা, গেমস পড়ালেখার অংশ হলে খুব ভালো হতো, তাই না? তখন পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কীভাবে ভালো হতো? সে খুব জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে বলল, বা রে, চারপাশে সবাই যেটা ব্যবহার করে সেটা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান থাকা উচিত না? তার বয়সের তুলনায় মতামতটা একটু ভারী হলেও আসলে সেটাই হওয়া উচিত ছিল।
কারণ চীন, জাপান, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় তার বয়সী শিশুদের পড়ালেখার একটা বড় অংশজুড়ে থাকে মজার লজিক ও বাস্তব সমস্যার সমাধান করা। তারা স্কুলে খেলার ছলে কোডিং শেখে। যার ভিত্তিতে শিশুদের গেমসগুলো তৈরি হয়। দলবদ্ধ হয়ে জটিল সব সমস্যার সমাধান করে। পরবর্তী কালে তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে বিশ্বমানের প্রোগ্রামার। অথচ আমাদের শিশুদের কাছে স্কুল রীতিমতো ভীতির জায়গা। সেখান থেকে বেরিয়ে আবার ছুটতে হয় কোনো কোচিং সেন্টারে নয়তো বদ্ধ রুমে প্রাইভেট টিউটরের কাছে! ফলে শেখাটা আনন্দদায়ক হয়ে ওঠার সুযোগ কোথায়?
এ ধারা পরবর্তীকালেও বহাল থাকে। তখন তো আর হোমওয়ার্ক থাকে না, ফলে শেখাটা বাদ পড়ে যায়। কিন্তু পেশাগত জীবনে সত্যিকারের ভালো করার জন্য প্রয়োজন নানা শিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নেয়া। তাছাড়া লেখাপড়া মানেই ভীতিকর বিষয় হওয়ায় তারা কর্মজীবনে প্রশিক্ষণকেও শুধু নিয়মরক্ষার অংশ হিসেবে দেখেন। অর্থাৎ যেটুকু না করলেই নয়, মুখরক্ষার তাগিদে শুধু সেটুকুতে অংশ নেন। সেখান থেকে সমৃদ্ধ হওয়ার কোনো চেষ্টা বা আকাঙ্ক্ষা সাধারণত থাকে না।
অনেকে সেগুলোয় অংশ নেন জাস্ট কয়েক দিনের ছুটি ও দৃশ্যমান ইনসেনটিভ পাওয়ার জন্য। ট্রেনিং প্রোগ্রাম থেকে শেখা বিষয় কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগের কোনো পরিকল্পনা সাধারণত থাকে না। অনেকে আবার স্পোকেন ইংলিশ কিংবা কম্পিউটার শেখার মতো টেকনিক্যাল বিষয়েও শুধু সনদ পেতে উদগ্রীব থাকেন। তারা ভাবেন সেটার বদৌলতে পদোন্নতি না হলেও অন্য কোনো সুযোগ (ইনক্রিমেন্ট) জুটে যেতে পারে!
অনেকে আবার ঠিকঠাক না শিখে সিস্টেমে একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স জোগাড়ে মরিয়া হয়ে ওঠেন! অথচ এটা ভাবেন না যে ওই সনদের ওপর ভর করে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামলে নিজে তো মরবেনই, সঙ্গে আরো অনেককে মারার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা এটা বুঝতে চাই না যে সাঁতার না শিখে যতই সার্টিফিকেট জোগাড় করি না কেন, পানি তো সেটা বুঝবে না। অনেকটা সেই গল্পের মতো। পথচারী দেখে এক কুকুর খুব ঘেউ ঘেউ করছে। তখন পাশের লোকটা বলল, ভয় পেয়ো না। তুমি কি জানো না, A barking dog seldom bites। তখন সে ভীত গলায় বলল, সেটা না হয় আপনি আর আমি জানি। কিন্তু কুকুরটা কি সেই প্রবাদ বাক্য জানে?
সম্প্রতি করপোরেট সেক্টরে কর্মরত মিড লেভেলের অনেকেই এক সংকটে ভুগছে। সেটা হলো, নিয়োগকর্তারা তাদের প্রমোশন দেয়ার পরিবর্তে সেই পজিশনে বিদেশী কর্মীদের নিয়োগ দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। ফলে দেড়-দুই দশক নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার পরেও অনেকে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এখন কথা হলো, কেন বিদেশী কর্মীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়? এর প্রধান কারণ হলো, তারা শেখার ব্যাপারে অত্যন্ত ইতিবাচক। দেশে-বিদেশে কোর্স করা, মেন্টরের সাহায্য নেয়ার ব্যাপারে তারা সদা সচেষ্ট থাকেন। সেগুলো করতে না পারলে অন্তত নিজ ফিল্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রচুর বই পড়েন। অথচ পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে যে নিয়মিত জ্ঞানার্জন ও সেগুলোর চর্চা করা দরকার, তা আমরা অনেকেই ধরতে পারি না।
অনেকে শুরুর দিকে বাধ্য হয়ে কিছুদিন প্রশিক্ষণ নেন। তারপর সারা জীবন তার ওপর ভর করে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। অথচ প্রতি বিশ বছরে নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটে। তাদের চিন্তাভাবনা-রুচিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। কিন্তু অধিকাংশই সেই মান্ধাতা আমলের পদ্ধতি ও উপাদান নিয়ে পড়ে থাকেন। অথচ গতিশীল প্রতিষ্ঠানগুলোয় (যেমন বহুজাতিক কোম্পানিতে) কিছুদিন পর পরই কর্মীদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। তাদের বিদেশে পাঠানো হয়। কারণ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে নতুন জ্ঞানের সাথে পরিচিত হওয়ার সর্বোত্তম উপায় হলো প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম।
অনেকেই ভাবেন, আমি কি কম বুঝি নাকি? এমনটা ভেবে নিজের মতো কাজ শুরু করেন। অধীনস্থদের নানা রকম নির্দেশনা দিতে থাকেন। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো পর্যায়ে বড় সমস্যা হলে আর সমাধান দিতে পারেন না। সেক্ষেত্রে অনেক বেশি অর্থ-সময়-মনোযোগ নষ্ট হয়। কিন্তু সেভাবে সুফল মেলে না। ঘরবাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে এমন সমস্যা প্রকট হয়। নিজে সব বুঝি ভেবে মিস্ত্রিকে নির্দেশনা দিয়ে কাজ শেষ করেন। কিন্তু পরে দেখা যায় ঘরে আলো-বাতাস ঢুকে না!
এক ভদ্রলোকের তো গ্রামের বাড়িতে দোতলা ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরে হুঁশ হয় যে ভবনে কোনো টয়লেট রাখা হয়নি! একজন মানুষ সব বিষয় নিজে বুঝবে, দক্ষ হবে, সেটা সম্ভব নয়। সেটা কারো কাছে আশাও করা হয় না। কিন্তু যে কাজ নিজে বুঝি না, সেক্ষেত্রে এক্সপার্টদের পরামর্শ নেয়া খুবই যৌক্তিক। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অপরিহার্য।
যাহোক, এখন চলছে বাঙালির প্রাণের উৎসবগুলোর অন্যতম অমর একুশে বইমেলা। সেখানে প্রতিদিন শতাধিক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হচ্ছে। গত কয়েক বছর বইমেলাগুলোয় গড়ে চার হাজারের বেশি নতুন বই এসেছে। এবার তার সংখ্যা বাড়বে বৈ কমার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কথা হলো, যারা এখানে অবদান রাখছেন, তাদের ঠিক কয়জনের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সত্যিকারের পড়াশোনা, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ রয়েছে?
ইউরোপ-আমেরিকায় ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্স খুব পপুলার। প্রথম দিকে ওদের কোর্সে অনেক স্টুডেন্ট দেখে অবাক হতাম। আমাদের দেশে আবৃত্তি শেখার জন্য তালিম নেয়ার রীতি থাকলেও কবিতা লেখা-শেখার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হয়, কথাটা প্রথম দিকে হজম করতে কষ্ট হচ্ছিল! আমি কোর্সে এনরোল না করলেও তাদের বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। লাইব্রেরিতে বসে বসে বেশকিছু বই পড়েছিলাম। আমার লেখার ক্ষেত্রে এখনো সেই শিক্ষা বিশেষভাবে সাহায্য করে।
বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোর সিংহভাগ নাকি কবিতার বই। অথচ গোটা দেশে কবিতা লেখা-শেখার কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোর্স রয়েছে বলে জানা নেই। অন্যান্য রচনার ক্ষেত্রও খুব একটা ব্যতিক্রম নয়। আমার জানামতে, দেশের হাতেগোনা কয়েকজনের বিদেশে এ বিষয়ে বিভিন্ন মেয়াদে কোর্স করা রয়েছে। অন্যরা গাইতে গাইতে গায়েন হতে চেষ্টা করছেন। এমনকি অনেকের পড়ার চেয়ে লেখার আকাঙ্ক্ষা তীব্র!
তদুপরি সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রে আমাদের পরম্পরার অভাব খুব প্রকট। আগের দিনে লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের বিশেষ কিছু আড্ডার কালচার ছিল। সেগুলো কিছুটা হলেও শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের মতো কাজ করত। নবীনরা প্রবীণদের কাছ থেকে গল্পচ্ছলে অনেক কিছু শিখত। এখন সবাই ব্যস্ত। তাছাড়া সোস্যাল মিডিয়ায় রয়েছে হাজার বা লাখো ফ্যান-ফলোয়ার। ফলে মন খুলে কথা বলা কিংবা সিনিয়র-জুনিয়রদের মতবিনিময়ের তেমন সুযোগ কোথায়?
ফলে আমরা সবাই স্বশিক্ষিত লেখক-কবি-সাহিত্যিক হয়ে জাতিকে সমৃদ্ধ (উদ্ধার) করতে সচেষ্ট রয়েছি। এমন চেষ্টায় কোনো রকমে কাজ চালিয়ে নেয়া গেলেও বিশ্বমানের সৃষ্টিশীল কাজ পাওয়া সম্ভব নয়। হয়তো সে কারণেই হাজার হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের চর্চায় আমরা ভাগ্যক্রমে একজন নোবেল বিজয়ী পেয়েছি। আবার কবে পাব তা অনুমান করাও মুশকিল।
তাই মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে, পরিসংখ্যান বলছে আমাদের আর্থিক সমৃদ্ধি হচ্ছে। মানুষের হাতে অর্থ বাড়লে শরীরের আরামের নানা উপকরণ কেনে। কিন্তু সেগুলো দিয়ে তো মনের সুখ মেলে না। তাছাড়া মননশীলতারও উন্নয়ন হয় না। তাহলে ঠিক আর কতটা ‘উন্নয়ন’ হলে আমরা হার্ডওয়্যার ছেড়ে সফটওয়্যারে (প্রকৃতপক্ষে যা আমাদের চালায় তার প্রতি) মনোযোগী হব?