www.agribarta.com:: কৃষকের চোখে বাংলাদেশ
শিরোনাম:

শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাদুল্লাহ স্যার: আপনার কর্মের মাঝেই আপনি বেঁচে থাকবেন


 এগ্রিবার্তা ডেস্কঃ    ২৮ মার্চ ২০২০, শনিবার, ৮:৪০   সম্পাদকীয় বিভাগ


অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মনে জানাচ্ছি যে, এনিম্যাল সায়েন্স বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. এম. সাদুল্লাহ বিগত ২৬ মার্চ ২০২০ তারিখ দুপুর ২:৩০ ঘটিকায় বারডেম হাসপাতাল, ঢাকায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। ১৯৪১ সালের ৩ জানুয়ারি শরীয়তপুর জেলার শফিপুর থানার চরভাগারা গ্রামে এক সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন এম. সাদুল্লাহ। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে স্নাতক ও ১৯৬৭ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপরই তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এনিম্যাল সায়েন্স বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।

পরবর্তীতে ১৯৭৭-৭৮ সালে ফেলোশিপ নিয়ে হাইয়ার পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি নেন ডেনমার্ক রয়েল ভেটেন্যারি এন্ড এগ্রিকালচার ইউনির্ভারসিটি থেকে। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে তিনি এনিম্যাল সায়েন্স বিভাগের প্রধান, হল প্রভোষ্ট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রির্সাচ সিস্টেম (বাউরেস) এর পরিচালক, পশুপালন অনুষদের ডীন, সিন্ডিকেট সদস্য সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি বিশ্বের খ্যাতনামা বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন ড. এম. সাদুল্লাহ। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব এঙলিয়া, ইরানের উর্মিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অবসরে যাওয়ার পর ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন তিনি। এছাড়াও ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালেয়েশিয়া, মেক্সিকো, জাপান, কোরিয়া ও ইংল্যান্ডসহ আরো অনেক দেশে তিনি কৃষি ভিত্তিক সেমিনার ও কর্মশালায় অংশগ্রহন করেছেন এবং তার গবেষণার বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন। বর্হিবিশ্বে তাঁর এ কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলসহ তৎকালীন অনেক নবীন শিক্ষকের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করেছিলো।

বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ গবেষণায় এক নিবেদিত প্রাণ ছিলেন প্রফেসর ড. এম. সাদুল্লাহ। তিনি একজন প্রথিতযশা গবেষক ছিলেন। তিনি ৩৫০’র বেশী গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তার জীবদ্দশায়। তাঁর উদ্ভাবনের মধ্যে ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক, পশুখাদ্যে মোলাসেসের ব্যবহার, ইউরিয়া ট্রিটেট স্ট্র অন্যতম। এছাড়াও গবাদী পশু মোটাতাজাকরনের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নতি, ইন্টিগ্রেটেড লাইভস্টোক ফার্মিং এর উপরও তিনি অনেক কাজ করেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রোটারি ইন্টারন্যাশনাল এর যৌথ প্রকল্প ‘Livestock and Poultry Development’ এ কাজ করেন প্রায় পাঁচ বছর। ১৯৮৭ সালে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মিং সিস্টেম এর ওপর আরো চার বছর গবেষণা করেন ড. এম সাদুল্লাহ। এছাড়া স্কটল্যান্ডের Rowett Research Institute এ রিসার্চ ফেলো হিসেবে ১৯৯১-৯২ সাল পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। ১৯৯৫-৯৬ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কনসালট্যান্ট হিসেবে প্রাণিখাদ্য টেকনোলজি নিয়ে কাজ করেছেন চীনে। ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় প্রাণিসম্পদের ক্ষয়ক্ষতির জরিপ হয়েছিলো তাঁর নেতৃত্বেই। এছাড়াও তিনি একাধিক বই লিখেছেন। কিছুদিন আগেও সমন্বিত হাঁস মুরগি পালনের উপর তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। আমৃত্যু তিনি দেশের প্রাণিসম্পদের উন্নতিকল্পে কাজ করে গেছেন। পেশাদারিত্বের এক অনন্য উদাহরণ প্রফেসর ড. এম. সাদুল্লাহ। তিনি পশুপালন পেশার উন্নতিকল্পে অনেক কাজ করে গেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত স্মার্ট ও প্রযুক্তি সচেতন সৌখিন মানুষ ছিলেন। সহকর্মীদের প্রিয়ভাজন ও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাইন্টিস্ট ছিলেন। আশির দশকের শেষের দিকে নিজস্ব উদ্যোগে তাঁর একটি ব্যক্তিগত কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ছিলো যেটি তখন বাকৃবিতে বিরল। তাঁর কম্পিউটার ও ইমেইল ব্যবহার করে অনেক সহকর্মীই বিদেশে প্রফেসরদের কাছে লিখতেন পিএইচডির জন্য। তৎকালীন জুনিয়র সহকর্মীদের অনেকেই তাঁর কম্পিউটার ব্যবহার করেছেন। এনিম্যাল সায়েন্স বিভাগের অনেক স্যার তাঁর কম্পিউটারে মাস্টার্সের থিসিস ও করেছেন। অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি সবসময়ই সহকর্মীদের উচ্চশিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময়ই ছিলেন আপোষহীন। তাঁর বিদেশী অনেক বন্ধু ও ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডিপাটমেন্টের অনেক স্যারই বলেছে বিদেশে তাদেরকে সাদুল্লাহ স্যারের কথা জিজ্ঞেস করেছিলো যে চিনো কিনা, কেমন আছেন এসব। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের সীমাবদ্ধতার সেই সময় আপনি যে আন্তর্জাতিক নেটওর্য়াক তৈরী করেছিলেন, শিক্ষা ও গবেষণায় যে অবদান রেখেছেন, সেটি সত্যিই আমাদের জন্য অনুকরনীয়। আপনার কর্মের মাঝেই আপনি বেঁচে থাকবেন।

কিছুদিন আগে আমরা এনিম্যাল সায়েন্স বিভাগ থেকে স্যারকে দেখতে তাঁর বাসায় যাই। স্যার ঢাকায় বাসাবোতে নিজস্ব বাসায় থাকেন। স্যার তখন খুবই অসুস্থ ছিলেন। কথা বলতে পারছিলেন না। শুধু ইশারা করে তাঁর লেখা নতুন বইটা দেখালেন। আমাদেরকে নয়নভরে দেখছিলেন আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো। কথা বলতে না পারলেও প্রাণের মানুষদের যে উনি কতটা ভালবাসেন তা হয়তো চোখের পানিতে বুঝাচ্ছিলেন। আমরাও আপনাকে ভালবাসি স্যার। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা উনি যেনো আপনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।

বৈবাহিক জীবনে তিনি দুই মেয়ে ও এক পুত্রের জনক। তিনি অত্যন্ত গুণী, মেধাবী ও সকলেন নিকট শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি উদার মনের, অমায়িক ও স্পষ্টভাষী উচ্চ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন বরেণ্য শিক্ষক ও প্রথিতযশা গবেষককে হারালো। আমরা হারালাম আমাদের অভিভাবককে। আমরা এ বরেণ্য শিক্ষকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি ও তাঁর শোকসন্তপ্ত পবিরবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।


মোঃ নূরন্নবী ইসলাম
লেকচারার
এ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
email: sagor.as@bau.edu.bd




  এ বিভাগের অন্যান্য