www.agribarta.com:: কৃষকের চোখে বাংলাদেশ
শিরোনাম:

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবসঃ বৈশ্বিক ও স্থানীয় ভেটেরিনারি পেশার পর্যালোচনা


 এগ্রিবার্তা ডেস্কঃ    ২৫ এপ্রিল ২০২০, শনিবার, ১২:৩২   সম্পাদকীয় বিভাগ


প্রতিবছর এপ্রিলের শেষ শনিবার বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন কতৃক ঘোষিত "বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস" পালিত হয়ে আসছে ২০০১ সাল হতে ৷ বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন প্রতিষ্টিত হয় ১৯৫৯ সালে৷ বাংলাদেশে The Vet Executive এর হাত ধরে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ২০০৮ হতে ৷ বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন এবং বিশ্ব প্রানি স্বাস্থ্য সংস্থ্যা যৌথ ভাবে এ দিবস উপলক্ষে ভেটেরিনারি পেশা এবং মানব সমাজের কল্যানে অবদান রাখার জন্য "বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস এওয়ার্ড" ও ঘোষনা করে থাকে৷ এই এওয়ার্ডের প্রচলন শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে৷ এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়; “Environmental protection for improving animal and human health.” প্রতি বছর নানা সভা সেমিনার এবং উৎসাহ উদ্দিপনার মাঝে দিবসটি পালিত হয়ে আসলেও বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটু অন্যরকমভাবেই পালিত হচ্ছে দিবসটি৷

ভেটেরিনারি শব্দের উৎপত্তি লাটিন শব্দ "veterinae" থেকে যার অর্থ "working animal"৷ ভেটেরিনারিয়ান শব্দটি মুদ্রণে প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৬৪৬ সালে টমাস ব্রাউনির দ্বারা। একজন ভারতীয় ঋষি এবং প্রানী বৈদ্যিক শালিহত্রা (পৌরানিক মতে খ্রীস্টপুর্ব ২৩৫০) যে কিনা হায়াঘোষা ঋষির পুত্র, তাকে এই পেশার জনক বলে ধরা হয়৷ অনেকের মতে যদিও প্রাচীন মিশরে এই পেশার প্রথম বিস্তৃতি ছিল৷ সম্রাট অশোক ভারত বর্ষে দু ধরনের ঔষধের প্রচলন করেন, একটা মানুষের অপরটি পশুপাখির জন্য৷ প্রাচীন বাইজেনটাইন শাসনে Hippiatrica যা দিয়ে শুধু ঘোড়ার বিশেষায়িত চিকিৎসাকে বোঝানো হত। মধ্যযুগে ভেটেরিনারি পেশাকে শুধু ঘোড়ার চিকিৎসাকেই বেশি উল্লেখযোগ্য রুপে প্রকাশ করা হত, ঘোড়ার অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে। আরবে একে বলা হত "বায়তারা" যেটা শুরু করেছিলেন ইবনে আখি হিজাম (নবম দশকে)। সতের শতকে কাউপ্লেগের প্রকোপ শুরু হলে সেদিকে Claude Bourgelat মননিবেশ করেন৷ তার ফলশ্রুতিতে ১৭৬২ সালে প্রথম ভেটেরিনারি স্কুল প্রতিষ্টিত হয়৷ ভেটেরিনারি পেশা তার স্বরুপে উদ্ভাসিত হয় উনিশ শতকে৷ স্যার জন ম্যাকফাডিয়ান কে তার অসামান্য অবদানের জন্য আধুনিক ভেটেরিনারি রিসার্চের জনক বলে।

পোস্ট গ্রেজুয়েশন এবং রিসার্চ জগতে ভেটেরিয়ানদের সদর্প পদাচারনা এখন সারা বিশ্বে। হোক সেটা ফার্মকোলজি কিংবা ইপিডেমিওলজি। রিসার্চ ভেটেরিনারিয়ানরা প্রথম অনকোভাইরাস, সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া, ব্রুসেলা ছাড়াও অনেক জীবানুর আবিস্কারক। ভেটেরিনারিয়ানরা বটুলিজম জন্য দ্বায়ী জীবানু থেকে এন্টিকোয়াগুলেন্ট আবিস্কার করে যেটা মানুষের হার্টের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার স্টেট ভেটেরিনারি অফিসার পিটার সি. ডোর্হাটী যৌথভাবে রোফ লিংকারনাজেল এর সাথে মেডিসিনে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। শরীরে ইমিউন সিস্টেম ‘মেজর হিসটোকমপ্যাটিবিলিটি কমপ্লেক্স ’ ব্যবহার করে কিভাবে ভাইরাস আক্রান্ত কোষকে সনাক্ত করা যায় সেটি তারা নির্ণয় করেন। বিভিন্ন শৈল চিকিৎসার পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন ভেটেরিনারিয়ানরা, যেমন হিপ জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট, পা প্রতিস্থাপন, অঙ্গ প্রতিস্থাপন ৷ যে কোন ঔষধের ট্রায়াল চালানোর জন়্য প্রানীর উপর প্রয়োগ করতে হয়, যেখানেও প্রয়োজন একজন ভেটেরিনারিয়ান। বর্তমানে সার্স ও কোভিড—19 এর কিটও আবিস্কার করেছেন বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা ভেটেরিনারিয়ান বিজন কুমার শীল। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি-আটলান্টা) সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথের সহকারী পরিচালক পিটার বি ব্লোল্যান্ড তাঁর উপস্থাপনায় বলেছিলেন, এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৪০০ জীবাণু দ্বারা মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস আছে। এসব জীবাণুর ৬১ শতাংশের উৎস প্রাণিজগৎ। তাই সে সকল রোগ প্রতিরোধে প্রথমেই প্রানীর রোগদমন করতে হবে। বর্তমান সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একটি নতুন ধারনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যাকে বলা হয় হচ্ছে "ওয়ান হেলথ " মানব ও প্রানী স্বাস্থ্য সুরক্ষার মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে চলা৷ যেখানে ভেটেরিনারিয়ান এবং হিউম্যান ডাক্তার কাধে কাধ মিলিয়ে চলবে। এ ক্ষেত্রে Rudolf Virchow (1821–1902) এর উক্তিটি উদ্ধৃত করা যায়-


"Between animal and human medicine there is no dividing line—nor should there be. The object is different but the experience obtained constitutes the basis of all medicine.”

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস ২০২০ এর প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- “প্রাণী ও মানব স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য পরিবেশগত সুরক্ষা” অর্থ্যাৎ পরিবেশের নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে প্রানি ও মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদান করতে হবে। এখানেও ওয়ান হেলথের ভূমিকাই মুখ্য হিসেবে উঠে এসেছে। অর্থাৎ যদি পরিবেশ রক্ষা করা যায় তবে উভয় ই রক্ষা পাবে। বাংলাদেশে দু'হাজার সাল থেকে সাতটি নতুন রোগ শনাক্ত হয়েছে। যার সবগুলি পশু-পাখি ও কীট-পতঙ্গের মাধ্যমে ছড়ায়। প্রতি বছর পশুপাখি থেকে গড়ে তিনটি নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এসব রোগ সংক্রমণের জন্য দায়ী ভূমি ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন, শিল্পের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, নতুন পদ্ধতিতে পশুসম্পদ ব্যবস্থাপনা। আইডিসিআরের প্রধান মিরযাদি সাব্রিনা ফ্লোরা বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে রয়েছে এর একটি বড় সম্পর্ক।

তিনি বলছেন "জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে কিছু জীবাণু বংশ বৃদ্ধি করতে পারছে বেশি। কিছু জীবাণু নতুনভাবে শক্তিশালী হয়ে মানুষ বা পশুকে আক্রান্ত করছে। কোন কোনো জীবাণু ছিলো আগে শুধু পশুকে আক্রান্ত করতো এখন পরিবর্তিত হয়ে মানুষকেও আক্রমণ করার সক্ষমতা অর্জন করছে। আবার মানুষ থেকে মানুষ ছড়াতো না কিন্তু এখন ছড়াচ্ছে। এসব কিছু সমসাময়িক ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে হচ্ছে এবং শুধু বাংলাদেশে না সারা বিশ্বব্যাপী হচ্ছে।" বর্তমান হালে ত্রাস কোভিড -19 এর উৎস হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে বাদুর এবং বনরুই কে। যার রহস্য উদঘাটনে দিন রাত পরিশ্রম করছে ভেটেরিনারিয়ান এবং হিউম্যান ডাক্তার উভয়ে৷

এখন পরিবেশ ও আবহাওয়ার পরিবর্তনে প্রাণীজগতেও পরিবর্তন আসছে অনেক। প্রাণীদের বাসস্থান বদলে যাচ্ছে, তারা কি খাচ্ছে এবং তাদেরকে কে খাচ্ছে - তাও বদলে যাচ্ছে। মানবজাতির ৫৫ শতাংশই এখন শহরে থাকে। এই সব বড় বড় শহরে বন্যপ্রাণীরা বিশেষকরে ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, শিয়াল, নানা রকম পাখী, বানরসহ বহু প্রাণীই শহরের পার্কে বাসা বাঁধছে , তারা মানুষের ফেলে দেয়া খাবার খাচ্ছে। এর ফলে শহরগুলো হয়ে উঠছে নানা রকম রোগের বিবর্তনের কেন্দ্র। শহরে বহু মানুষ পরস্পরের খুব কাছাকাছি বাস করে, তারা একই অফিস ভবনে কাজ করছে, এক বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে, একই ট্রেন-বাস-বিমানে উঠছে, বহু লোক একই জিনিস স্পর্শ করছে - তাই রোগ ছড়াতেও পারছে খুব সহজে। কোন কোন জনপদের সংস্কৃতিতে শহরের মানুষ বন্যপ্রাণীর মাংস খায়। এসব বন্যপ্রাণী ধরা হয় শহর থেকেই বা আশপাশের জঙ্গল থেকে। এরকম নানা কারণে অনেক নতুন রোগের ভাইরাস, নতুন নতুন প্রাণীর দেহে ঢুকে আরো বিপজ্জনক রূপ নিচ্ছে। এই সমস্যা মোকাবিলা করার কাজটা খুবই জটিল। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ - এগুলোর মাধ্যমে রোগ বিস্তার ঠেকানো বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

বাংলাদেশ ও ভেটেরিনারি পেশা:
বাংলাদেশে নানা চড়াই উৎড়াই এর মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে ভেটেরিনারি পেশা। আজ বাংলাদেশ থেকে রিন্ডার পেস্ট রোগ সম্পূর্ন দূর করতে সক্ষম হয়েছে ভেটেরিনারিয়ানদের ফলেই। আজ দেশ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ন। বাংলাদেশে দুধ উৎপাদন মাথাপিছু ১৬৫ মিলিলিটার৷ গত এক দশকে দুধ উৎপাদন বেড়েছে ৩.২ গুন। মাংসের চাহিদা ১২০ গ্রামের তুলনায় উৎপাদিত হচ্ছে ১২৫ গ্রাম করে। গত কোরবানী ঈদে ১০ লাখ গবাদিপশু চাহিদার অতিরিক্ত ছিল। মানুষের বছরে ১০৪টি ডিম দরকার, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ১০৩টি। আর এই সকল কিছুই সম্ভব হচ্ছে ভেটেরিনারিয়ানের প্রশিক্ষন ও সেবার ফলে ৷

তবে উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পেত যদি সেবার পরিসর কে আরো বৃদ্ধি করা যেত। প্রান্তিক জনগোষ্টির বিপুল চাহিদা থাকা স্বত্তেও আজও উপজেলা লেভেলে একজন করে ভেটেরিনারিয়ান, যেখানে কৃষি কর্মকর্তা ইউনিয়ন পর্যন্ত চলে গেছে। উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতাল কে আধুনিকরন ও জেলায় আধুনিক হাসাপাতাল প্রতিষ্ঠার কোন পরিকল্পনাও নেয়া হয় নি স্বাধীনতার ৪৯ বছরে। বেসরকারি পর্যায়ে সঠিক নীতিমালার অভাবে পদে পদে অবহেলিত হচ্ছে ভেটেরিনারিয়ান বৃন্দ। দেশে শুধুমাত্র একটি সরকারি লাইভস্টক রিসার্চ ইন্সটিটিউট রয়েছে যাতেও রয়েছে নানা অপ্রতুলতা। বাংলাদেশ লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে নামে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্টানটিতে নেই ভেটেরিনারিয়ানের কর্মের সঠিক সুযোগ। লাম্পি স্কিন ডিজিজ, ক্ষুরা রোগ, বার্ড ফ্লু মত রোগের প্রকপে যখন দেশের প্রান্তিক চাষীরা দিশেহারা তখন সঠিক গবেষনা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা এবং ভেটেরিনারিয়ানদের অভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে কৃষক ও খামারিদের।

আজ বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবসে আমরা বলতে চাই, ঝরাগ্রস্ত প্রাণিরা যদি সঠিক চিকিৎসা পায়, খামারিদের মুখে যদি প্রশস্তির হাসি ফুটে উঠে, ভেটেরিনারিয়ানরা যদি পান প্রাপ্য সম্মান ও মুল্যায়ন তবেই সার্থক হবে "বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস" ৷

লেখকঃ
ডাঃ সাজেদুল হক শৈবাল
ডিভিএম, এম এস ইন প্যাথলজি (বাকৃবি)
কাস্টমার সার্ভিস অফিসার
এসিআই এনিমেল হেলথ
মেইলঃ saibaldvm@gmail.com




  এ বিভাগের অন্যান্য