www.agribarta.com:: কৃষকের চোখে বাংলাদেশ
শিরোনাম:

রোগ প্রতিরোধে প্রাণিজ প্রোটিনের ভূমিকা


 ডাঃ মোঃ আবু বকর    ১২ মে ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:০৭   সম্পাদকীয় বিভাগ


মানবদেহের মোট ১৪-১৬ ভাগই প্রোটিন (আমিষ) দিয়ে তৈরি। প্রোটিন এমন একটি অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান যা দেহকোষ, হরমোন, এনজাইম ইত্যাদির গাঠনিক উপাদান হিসেবে শারীরবৃত্তিয় নানা কার্যাবলী সম্পাদন করে। তাপশক্তি উৎপাদন, রক্ত উপাদান তৈরি, দৈহিক বৃদ্ধি সাধন, ক্ষয়পূরণ, মানসিক বিকাশ, অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের শোষণ ও বিপাকীয় কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণসহ প্রোটিন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেহকে নানা সংক্রমণ হতে রক্ষা করে। এজন্য সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় একজন মানুষকে দৈনিক প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ০.৮ গ্রাম প্রোটিন খাবারের মাধ্যমে গ্রহন করতে হয়। কিন্তু মানব শরীর যখন কোনো জীবাণুঘটিত সংক্রমণ কিংবা আঘাতজনিত অসুস্থতায় ভোগে তখন প্রোটিনের চাহিদা নানা কারণে বহুলাংশে বেড়ে যায়।

ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া কিংবা অন্যান্য জীবাণুঘটিত সংক্রমণ দেখা দিলে শরীর দুইটি প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে সংক্রমণ-মুক্তি লাভ করে। একটি দেহের সহজাত ইমিউন বা অনাক্রম্যতন্ত্র ব্যবস্থা (Innate Immune System), অন্যটি অভিযোজিত ইমিউন ব্যবস্থা (Adaptive Immune System)। ন্যাচারল কিলার সেল, মাস্ট সেল, ফ্যাগোসাইট ইত্যাদি শ্বেত রক্তকণিকা সহজাত ইমিউন ব্যবস্থায় প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যখন সহজাত ইমিউন ব্যবস্থা জীবাণুর সাথে পেরে উঠেনা তখন অভিযোজিত ইমিউন ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলে। টি-সেল এবং বি-সেল নামক দুইটি লিম্ফোসাইট (এক প্রকারের শ্বেত রক্তকণিকা) এই প্রতিরোধ ব্যবস্থায় আক্রান্ত দেহকোষ ধ্বংস ও এন্টিবডি তৈরি করার মাধ্যমে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাটি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হতে দিন থেকে সপ্তাহখানেক সময় নেয়। যখন এটি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন শরীর জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যত জিতে যায়। অভিযোজিত ইমিউন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রত্যেক জীবাণুর জন্য নির্দিষ্ট এবং এর স্মৃতিধারণ ক্ষমতা রয়েছে। একারণে, একই জীবাণু দ্বারা দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ঐ জীবাণুকে চিনে ফেলে এবং দ্রুত প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে ধ্বংস করতে পারে। ইমিউন ব্যবস্থা সক্রিয় হওয়ার জন্য আক্রান্ত দেহকোষ ও বিভিন্ন ধরণের শ্বেত রক্তকণিকার মাঝে আন্তঃযোগাযোগ থাকতে হয়। ইন্টারলিউকিন, লিম্ফোকাইন, ইন্টারফেরন ইত্যাদি সাইটোকাইন কোষীয় সংকেত (সেল সিগন্যালিং) এর মাধ্যমে আন্তঃযোগাযোগ রক্ষা করে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ভাইরাসজনিত সংক্রমণ হলে সহজাত প্রতিরোধ হিসেবে আক্রান্ত দেহকোষ ইন্টারফেরন তৈরি করার মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী সুস্থ দেহকোষকে এই বলে সংকেত দেয় যে 'ভাইরাস আসছে, তাড়াতাড়ি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোল'। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় জড়িত এসব শ্বেত রক্তকণিকা, এন্টিবডি ও সাইটোকাইন প্রোটিন দিয়ে তৈরি।

সংক্রমণ অথবা আঘাতজনিত কারনে যখন শরীরের কোনো টিস্যু ক্ষয় হয় (করোনা ভাইরাস ফুসফুসের টিস্যু ক্ষয় করে) তখন গ্রোথ হরমোন, ইনসুলিন, ইনসুলিন সদৃশ গ্রোথ ফ্যাক্টর-১, টেস্টোস্টেরন ইত্যাদি অ্যানাবলিক হরমোন দেহের ক্ষয়পূরণ করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। একমাত্র টেস্টোস্টেরন ছাড়া বাকি সবগুলো হরমোন প্রোটিন বা পেপটাইড হরমোন। দেহে প্রোটিনের ঘাটতির কারনে এই প্রোটিন হরমোনগুলোর উৎপাদন যদি ব্যহত হয় তাহলে দেহের ক্ষয়পূরণ প্রক্রিয়া মন্থর হয়ে যাবে।

প্রোটিনের গাঠনিক উপাদান অ্যামাইনো অ্যাসিড। অর্থাৎ প্রোটিন ভাঙলে অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যাবে এবং প্রোটিন তৈরি করতে হলে অ্যামাইনো অ্যাসিড লাগবে। শারীরবৃত্তিয় নানা কাজে প্রোটিনের ভাঙন-গড়ন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই ভাঙন-গড়নের আনুপাতিক তুলনা করা যায় শরীরের নাইট্রোজেনের ব্যাল্যান্স বা ভারসাম্য দেখে। কারণ, নাইট্রোজেনের মূল উৎস হল প্রোটিন বা অ্যামাইনো অ্যাসিড। যখন দেহের অভ্যন্তরীণ প্রোটিন ভাঙন ও খাবারের মাধ্যমে প্রোটিন গ্রহনের পরিমাণ সমান হয় তখন নাইট্রোজেনের ভারসাম্য নিউট্রাল বা নিরপেক্ষ থাকে। স্বাভাবিকভাবেই জীবাণুঘটিত সংক্রমণ কিংবা আঘাতজনিত অসুস্থতায় প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া (Inflammatory Response) দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়ার সময় মানব শরীরে প্রোটিন ভাঙন তথা নাইট্রোজেনের অপচয় বেড়ে যায়। ফলস্বরূপ দেহাভ্যন্তরে নাট্রোজেনের একটি ঋনাত্মক ভারসাম্য তৈরি হয়। এই ঋনাত্মক ভারসাম্য নিরপেক্ষ বা ধনাত্মক করার জন্য প্রোটিনের প্রয়োজন হয় যা খাবারের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয়। অসুস্থ অবস্থায় খাবারের রুচি কমে যাওয়ায় অনেক সময় আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার খেতে পারিনা অথবা যে খাবার খাই তাতে পর্যাপ্ত প্রোটিন থাকেনা। প্রোটিন গ্রহন ও প্রোটিন ভাঙনের এই অসামঞ্জস্যতার ফলে দেহের মাংসপেশি ক্ষয় হতে থাকে থাকে। এজন্য খুব বেশি অসুস্থ হওয়ার পর পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার গ্রহন না করলে ক্ষয়জনিত কারনে শরীর শুকিয়ে যায়।

সুস্থ, অসুস্থ যেকোনো অবস্থায় প্রতিদিন খাবারের মাধ্যমে প্রোটিন গ্রহন করতে হয়। কেননা শর্করা ও চর্বির মত প্রোটিন শরীরে জমা হয়না। অতিরিক্ত প্রোটিন খেলে তা রূপান্তরিত হয়ে শর্করা হিসেবে দেহে জমা থাকে, প্রোটিন হিসেবে নয়। অতএব, সংক্রমণজনিত রোগ কিংবা তীব্র অসুখের সময়ে কেও যদি প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাবার বেশি খায় তাহলে শরীরের প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করতে বেগ পেতে হবেনা। এজন্য দৈনিক প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য সহনীয় অসুখে ০.৮-১.২ গ্রাম এবং গুরুতর অসুখে কিংবা সংকটপূর্ণ অবস্থায় ১.২-১.৫ গ্রাম প্রোটিন খেতে বলা হয়।

প্রোটিনের উৎস দুই ধরণের। একটি প্রাণিজ, আরেকটি উদ্ভিজ্জ উৎস। পুষ্টিমান নির্ভর করে প্রোটিনে বিদ্যমান অপরিহার্য বা অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিডের উপর। মানুষের শরীরে এ পর্যন্ত ২০ ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিডের সন্ধান পাওয়া গেছে। তম্মধ্যে ৯টি অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড আছে যেগুলো মানবদেহে সংশ্লেষ বা তৈরি হয়না এবং অবশ্যই খাবারের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয়। সকল প্রানিজ প্রোটিনে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড উপস্থিত থাকাতে উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের তুলনায় এর জৈব মান এবং পুষ্টি মূল্য বেশি। তাছাড়া, উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের (ডাল বা বীজ জাতীয়) পরিপাচ্যতা কম যা প্রাণিজ প্রোটিনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এজন্য প্রোটিনের উৎকৃষ্ট মানের উৎস হিসেবে আদিকাল থেকেই দুধ, ডিম, মাংস ও মাছ মানুষের কাছে সমাদৃত হয়ে আসছে। অপেক্ষাকৃত কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, সুলভ মূল্য ও সহজলভ্যতার কারণে লাল মাংসের তুলনায় পোল্ট্রির (মুরগি, হাঁস, টার্কি ইত্যাদি) সাদা মাংস ও মাছ সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। এছাড়া সুলভ মূল্যে প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর অন্যতম উৎস হল ডিম ও দুধ। দুধ, ডিম, মাংস ও মাছ শুধু উন্নতমানের প্রোটিনের যোগান দেয়না সেই সাথে অনেক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারক ভিটামিন ও মিনারেলও দেয়। তাই নিয়মিত এধরণের খাবার গ্রহন করলে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াসহ যেকোনো ধরণের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও দৈহিক ক্ষয়পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লেখকঃ
ডাঃ মোঃ আবু বকর
ডিভিএম (সিভাসু), এমএস (ফার্মাকোলজি), সিটি (ভারত)
প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা
উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর
দাগনভূঞা, ফেনী।




  এ বিভাগের অন্যান্য