
আবরার এর দেয়া স্ট্যাটাসের সাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে একমত। ভিন্নমত পোষণের কোনও কারণই দেখি না। উপরন্তু এই বয়সের একটা ছেলের পড়াশুনা ও জানার গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কমদিন হলো তো ছাত্র পড়াই না। এক দশক তো পার করেই দিলাম। কিন্তু এমন গভীরতা এই বয়সী ছেলেদের মাঝে খুব কমই দেখেছি আমি। আমি মুগ্ধ। জানি এসবে আজ আর কিছুই যায় আসে না। যার সন্তান গেছে একমাত্র তিনিই জানেন কি হারালেন!
এই ঘটনা পড়ার পর থেকেই আমার মনে পড়ে যাচ্ছে মর্গে থাকা সাদের কথা। সেদিন সারাদিন ছিলাম মর্গে দাঁড়িয়ে। আবরারের শরীরের আঘাতের চিহ্ন দেখে বারবার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সাদের শরীরের চিহ্নগুলো। আমি আবরারকে নিয়ে আসা কোনো স্ট্যাটাস বা খবর পড়তে পারছি না। কেননা আমার কাছে সাদ বা আবরার আলাদা কেউ না। এই ব্যর্থতা, গ্লানি আর দায় সারাজীবন থেকে যাবে। এই যন্ত্রণা নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, সেদিন প্রক্টোরিয়াল বডির একজন আমিও ছিলাম। আর এই দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণা থেকে আমি এখনো বেরোতে পারিনি। হয়তো সবাই ভুলে যাবে কিন্তু আমি নিজে কোনোদিন ভুলতে পারবো না এই কথা। আমি আসলে এই কথাগুলো লিখতে চাইনি সবার সামনে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, না লিখে আর থাকতে পারলাম না মানুষজনের আস্ফালন দেখে। সাদের মৃত্যু নিয়ে অনেক ঘটনাই আমি রেখেছিলাম নিজের মাঝে। কিন্তু মনে হলো আজকে বলা উচিত।
সেদিন সকালে আমি পরীক্ষার ডিউটিতে ছিলাম। হঠাত প্রক্টর স্যারের ফোন আসলো ভিসি স্যারের অফিসে আসো। একজন ছাত্র মারা গেছে। তখনো আমি জানিনা কিভাবে কি ঘটেছে। ভিসি স্যারের অফিসে তাড়াতাড়ি পৌঁছালাম। ভিতরে গিয়ে দেখি ফিশারিজের এক স্যার অনেক হৈচৈ করছেন। সাথে অন্যান্য শিক্ষকরাও আছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ধীরে ধীরে জানতে পারলাম সাদের কথা।
সঙ্গে সঙ্গে প্রক্টর স্যার ও প্রক্টোরিয়াল বডির অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে সাদকে দেখলাম লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা। পা হলুদ হয়ে আছে। স্বাস্থ্যবান একজন তরুণ নিথর হয়ে পড়ে আছে শরীরে কালসিটে নিয়ে। বেশ অনেক্ষণ পর সাদের বাবা এলেন। প্রক্টর স্যার এগিয়ে কথা বলতে গেলেন। কিন্তু আমি যেতেই পারলাম না ওঁনার সামনে। কি স্থিরভাবে উনি বললেন যে, আমি মামলা করবো না। ছেলেকে তো আর পাবো না। আমার ছেলেকে দিয়ে দেন তাড়াতাড়ি নিয়ে যাই। এই বাবার সামনে কিভাবে দাঁড়ানো যায়?
এরপর গেলাম হাসপাতালের পরিচালকের রুমে। ব্রিগেডিয়ার ফসী সাহেব। ওঁনার কাছে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাইলাম। আশ্চর্যজনক ভাবে কোনো সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেলো না শুধুমাত্র সেই আধাঘন্টার যখন সাদকে তার পরিচিত দুই ভাই ভোরবেলা হাসপাতালের বাইরে নিয়ে গেছে। না ওয়ার্ডের সামনের ফুটেজ; না ইমার্জেন্সির সামনের ফুটেজ। শুধুমাত্র ঐ আধাঘন্টাই উধাও! সেদিন কোথায় ছিলো সাদ হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর? কি ঘটেছিলো তার সাথে সেই সময়ে? কে কে ছিলো তারসাথে? কিভাবে পৌঁছালো কোনো বিশেষ দলের নেতার সেই প্রাইভেট ক্লিনিকে? যদি আরও ভালো চিকিৎসার জন্যই নেয়া হবে তাহলে সবকিছু এত গোপন করে রাখা কেন? তদন্ত কমিটির সামনে গরহাজির কেন? আরও ভালো চিকিৎসা করা তো অন্যায় না। তাহলে সাদকে সাথে নিয়ে যাওয়ার সত্য স্বীকার করতে অস্বীকৃতি কেন? সব প্রশ্নের উত্তরই অজানা। এসব বলার কারণ হলো তাদের অনেককেই দেখছি আবরার আর সাদকে নিয়ে অনেক স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।
এর পরদিন ছাত্র কল্যাণ বিভাগের ওএসডি মুনির স্যার (বর্তমানে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক) পরিস্কার বলে দিলেন উনি পদত্যাগ করছেন। ময়না স্যার আর আমিও সেরকমই মত দিলাম। এসময় ভিসি স্যার আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমরা সবাই গিয়ে এই ঘটনার দায় নিয়ে পদত্যাগের কথা ভিসি স্যারকে বললাম। ভিসি স্যার সবার সামনেই কেঁদে দিয়ে বললেন, তোমরা আমাকে এই বিপদের দিনে একা ফেলে চলে যাবে? তখনকার শিক্ষক সমিতিও আমাদের বলল যে সবাই মিলেই এগোতে হবে। অতঃপর ছাত্র-শিক্ষক সবার গালিগালাজ শুনতে শুনতে আন্দোলনের মাঝে নতুন রাজনীতির খেলার মধ্যে পড়ে গেলাম।
ফোরামে তখন নতুন প্রক্টর কে হবেন সেই নিয়ে রশি টানাটানি। শিক্ষক সমিতিও সবার সামনে আমাদের পদত্যাগের আন্দোলনে সরব। এ এক বিচিত্র চেহারা এই শিক্ষকদের! শিক্ষক সমিতির জরুরী সভাতে প্রথমবারের মত বক্তব্য দিতে গিয়ে সবার উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলেছিলাম। আমরা তো দায় নিয়ে সরেই যেতে চেয়েছিলাম। আমাদেরকে ভিসির বাসায় অনুরোধ করে রেখে এখন সবার সামনে এই স্টান্টবাজি কেন? আমরা সরতে চাচ্ছি না এই নাটক কেন? দরকারের সময় ব্যবহার করে এখন টয়লেট পেপারের মত ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন যে তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু মিথ্যাচারিতা কেন? আমরা নিজেরাই তো সরে যেতে চেয়েছিলাম। তখন আমাদের সাথে খেলা খেলে ছাত্র আন্দোলন কেন? শিক্ষক আন্দোলন কেন? ঠিক আছে সরাতে চান তো সরিয়েই ফেলেন। আমাদের পদত্যাগ এ আর কি যায় আসে? কিন্তু সবার জানা দরকার রাতের অন্ধকারে কি খেলা খেলেছে এই ফোরাম আর শিক্ষক সমিতি তখন।
সেসময় জরুরী সিন্ডিকেট সভা করে ৭ জনকে (সঠিক সংখ্যা মনে নাই) বিভিন্ন মেয়াদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। খুনের মামলাও করা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশেই এসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটিতে অনেকেই উপস্থিত হননি। সেই তদন্ত কমিটি শুধুমাত্র হলের ঘটনার উপর আলোকপাত করেছিলো বলেই আমার জানা (ভুল হতে পারে)। শুধুমাত্র ছাত্র সংশ্লিষ্টতা নিয়ে রিপোর্ট দিয়েছিলো বলেই আমি জানি। কিন্তু এর আড়ালে রয়ে গেছে অনেক কিছুই।
তখনও আমার বেশ কিছু প্রশ্ন ছিল, আজও আছে। যেকোনো অনুষদের ছাত্র সমিতি নির্বাচনের জন্য প্রক্টর অফিসে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করা হয় শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার জন্য। কিন্তু ফিশারিজের ছাত্র সমিতি সেই নির্বাচনের কোনো তথ্যই প্রক্টর অফিসকে জানানো হয়নি। এমনকি নির্বাচনের দিনক্ষণও জানানো হয়নি। ফিশারিজের ততকালীন ডীন একটি কমিটি করেন নির্বাচন পরিচালনার জন্য। যদি ভুল না হয়ে থাকে তবে ভিসির রুমে সাদের মৃত্যুতে হৈ চৈ করা সেই স্যার নিজেও ঐ কমিটিতে ছিলেন। কিন্তু ওঁনারা কেউই প্রক্টর অফিসকে কিছুই জানানোর প্রয়োজনই বোধ করেন নাই। ছাত্রদের কিছু অংশ ফিশারিজের ডীন স্যারকে অনুরোধ করেছিলো নির্বাচন স্থগিতের জন্য (পরে শুনেছি, সত্যমিথ্যা জানি না), কিন্তু তারপরও সেই কমিটি কিংবা ডিন মহোদয় নাকি নির্বাচন স্থগিত করতে রাজি হন নাই। যার জের ধরে এমন এক মর্মান্তিক ঘটনা। একথা মানে এই না যে, আমি কোনোভাবেই সমর্থন করি যে ভিন্ন মতের বা আদর্শের হলেই মেরে ফেলা। কিন্তু এমন পরিস্থিতি তৈরির দায় কি অনুষদের সেইসব (সবাই না) শিক্ষকরা এড়াতে পারেন? মাছের মায়ের পুত্রশোকের মত হয়ে গেলো না ব্যাপারটা!?
একটা হলে একজন ছাত্রকে একটি রুমে আটকে রেখে এমন নির্যাতন করা হলো... গার্ডরা জানে না? হাউজ টিউটর জানে না? প্রভোস্ট জানে না? হলের কোনো ছাত্র কোনো শিক্ষককে খবর দিলো না? হলে হেলথ সেন্টার থেকে ডাক্তার এলো এবং হাসপাতালে রেফার করলো। ডাক্তার কি হাউজ টিউটর, প্রভোস্ট কিংবা প্রক্টর কাউকে বলার প্রয়োজনবোধ করলেন না এমন গুরুতর রোগীর ব্যাপারে? তিনি যে বুঝেন নাই তা তো না। গ্যারেজ থেকে অ্যাম্বুলেন্স এলো, হাসপাতালে নেয়া হলো। গ্যারেজের ডিরেক্টর বা সংশ্লিষ্ট অফিসার কাউকে কিছু জানালো না? ক্যাম্পাস থেকে রাতের বেলা অ্যাম্বুলেন্স বের হলো। যেকোনো গেট দিয়ে বেরোবার সময় নিরাপত্তারক্ষী থাকে এবং গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করে। নিরাপত্তা শাখা থেকেও কোনো খবর পাওয়া গেল না? আমি সন্ধ্যার ভিজিলেন্স আর প্রক্টর স্যার কোথাও কাজে পাঠালে যেতাম। একই ব্যাপার আরও দুজন সহকারী প্রক্টর স্যারদের জন্যও। আমাদের রাজনৈতিক ব্যাপারে সংশ্লিষ্টতা ছিলো না। কিন্তু ছাত্র-কল্যাণের উপদেষ্টা এবং ও এস ডি স্যারের কাছেও নাকি কোনো তথ্য নেই। এতগুলো না একসাথে কিভাবে ঘটতে পারে? কোনো আন্দোলনেই এসব নিয়ে প্রশ্ন নেই!!!!
আজকে ফেসবুকে দেখি অনেক অনেক সুধী ব্যক্তি বলছেন বাকৃবি নিয়ে। শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করা নিয়ে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা নিয়ে। আমি বন্ধ চালু কিছু নিয়েই বলছি না। বলছি সেইসব ব্যক্তিদের নিয়ে যাদের আসল চেহারাটা আমি দেখেছিলাম সেই উত্তাল আন্দোলনের দিনগুলোতে। কি নোংরা আর কুৎসিত!!! সেদিন প্রশাসনিক পদে যাওয়ার জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করা, শিক্ষকদের মাঝে গ্রুপিং করা সবই চলছিল। কিন্তু হায়! সাদ চলে যাওয়ায় ওনাদের এই পৌষমাস সেসব কজনই বা বলবে! সময়মত ভোল পালটে ফেলাই তো এখন দস্তুর।
আমি কোনোভাবেই নিজের হয়ে অজুহাত দিচ্ছি না। কিন্তু সেইসব সুধী শিক্ষকদের বলছি, আজকে যে রাজনীতি বন্ধ করো বলছেন। নিজেরা তো অনেকেই এখনো প্রশাসনের বিভিন্ন পদ অলংকৃত করে আছেন শুধুমাত্র এই রাজনীতির অজুহাতেই। এসব পদ ছেড়ে দিয়ে কথা বলতে আসুন না!! নিজের যোগ্যতায় আছেন? তাহলে সোনালী দলের শিক্ষকদের যোগ্যতা কি আপনাদের চেয়েও কম যে ওঁনারা কোথাও কোনো পদে থাকতে নেই? এই নীতিহীন রাজনীতি দিয়েই এত দাপট আপনাদের ১২০০ একরের এই চত্বরে। তাও যদি হতো নিজস্ব আদর্শের রাজনীতি। ভেড়ার চামড়া গায়ে দিয়ে নেকড়ে হয়ে দলে ঢুকে আছেন অনেকে। এখানে কোনো আদর্শ নেই, কোনো নীতিও নেই। শুধুমাত্র একটাই লক্ষ্য কিভাবে একটা প্রশাসনিক পদ পাওয়া যায়, ফোরামে একটা পদ পাওয়া যায়। ভিসি হওয়ার দৌড়ে থাকতে হলে এসব তো দরকার!
রাজনীতিকে ব্যবহার করবো, রাজনীতি নিয়ে রাজনীতি করবো, কিন্তু মুখে বলবো বন্ধ করো এসব অনাচার। আমি রাজনীতির পক্ষে কিচ্ছু বলছি না। বলছি আপনাদের বিচিত্র ব্যবহার নিয়ে। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি আপনাদের দেখে যে, দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, জাতি বানানোর কারিগরদের রাজনীতি যদি এমন নোংরা আর সুবিধাভোগী হয়ে থাকে; তাহলে আর রাজনীতিকে দোষ দিয়ে কি হবে? ও বেচারার তো নিজের কোনো বক্তব্য নাই যে বলবে একে নিবো ওকে নিবো না। রাজনীতি আর রাজায় রাজায় হয় না... রাজার ঘরেও নাই..... শিক্ষক- ছাত্র রাজনীতিতে রাজাও নেই নীতিও নেই... উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ...
পূর্বা ইসলাম
সহকারী অধ্যাপক
ফার্মাকোলজি বিভাগ, বাকৃবি ও
পিএইচডি গবেষক
নটিংহাম ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য
ইমেইল- purba_islam@yahoo.com