www.agribarta.com:: কৃষকের চোখে বাংলাদেশ
শিরোনাম:

বিশ্ব দুগ্ধ দিবস: নিশ্চিত হোক ডেইরি খাতের টেকসইযোগ্যতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জীবিকা, পুষ্টি


 এগ্রিবার্তা ডেস্কঃ    ১ জুন ২০২০, সোমবার, ৩:০৪   সম্পাদকীয় বিভাগ


বিশ্ব দুগ্ধ দিবস বৈশ্বিক খাদ্য হিসেবে দুধের গুরুত্ব তুলে ধরার লক্ষ্যে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ঘোষিত একটি আন্তর্জাতিক দিবস। ২০০১ সাল থেকে প্রতিবছর ১ জুন দিবসটি পালিত হয়। Sustainability, Economic Development, Livelihoods, Nutrition (টেকসইযোগ্যতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জীবিকা, পুষ্টি) প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ১লা জুন, ২০২০ পালিত হবে ২০তম বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। করোনা ভাইরাস সংক্রমনজনিত কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক দুগ্ধ ফেডারেশন (আইডিএফ) র নির্দেশনা মোতাবেক দিবসটি ভার্চুয়ালি পালিত হবে।ডেইরি খাতের কার্যক্রম বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে দিনটি উদযাপিত হয়। বিশ্ব দুগ্ধ প্লাটফর্ম ২০১৮ ও ২০১৯ সালের দুগ্ধ দিবস উদযাপনের জন্য ‘‘এক গ্লাস বৃদ্ধি কর” ( #Raise a Glass, #WorldMilkDay) নামে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে।

শ্রেষ্টতম খাদ্য উপাদান হিসেবে স্বীকৃত সুপার ফুড দুধ খাদ্যগ্রহণে সক্ষম হয়ে ওঠার আগে এটিই হল স্তন্যপায়ী(মানুষসহ যারা স্তন্যপানকারী) শাবকদের পুষ্টির একমাত্র উৎস। বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা মানব শিশুর জন্য প্রথম ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ পান করাতে এবং দুই বছর বা তার অধিক বয়স পর্যন্ত বুকের দুধের সাথে অন্যান্য খাবার খাওয়াতে সুপারিশ করে। দুধকে বলা হয় সুপার ফুড বা সর্বগুণ সম্পন্ন খাবার। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, প্রোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি-১২, নিয়াসিন ও রিবোফ্লাবিন। দুধের নানা পুষ্টিগুণ আপনাকে সুস্থ, সবল ও নিরোগ রাখতে পারে। অ্যাসিডিটির সমস্যা, পিরিয়ডের সময় তীব্র যন্ত্রণা, কাজের স্ট্রেসে অস্থির অবস্থা- এসব সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে এক গ্লাস দুধ। প্রতিদিন মাত্র এক গ্লাস দুধ পানেই এমন অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি আমরা।

আসুন এবার জেনে নিই দুধের নানা উপকারিতা-

  • ক্যালসিয়াম দাঁত ও হাড়ের গঠন মজবুত করে।
  • দুধ পানের ফলে দেহের সব ধরণের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয় তাই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কম সময়ে ওজন কমাতে চাইলে, প্রতিদিনের ডায়েটে দুধ রাখুন।
  • দুধে থাকা ভিটামিন ও মিনারেল ফিটনেস বাড়ায় ও মানসিক চাপ দূর করতে সহায়তা করে। সারাদিনের মানসিক চাপ দূর করে শান্তির ঘুম নিশ্চিত করতে প্রতিদিন রাতে এক গ্লাস কুসুম গরম দুধ পান করুন।
  • দুধ শরীর রি-হাইড্রেট করতে সাহায্য করে। ডিহাইড্রেশনের সমস্যায় ভুগলে এক গ্লাস দুধ পান করে নিন।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা থাকলে এবং দুধজাতীয় খাবারে অ্যালার্জি না থাকলে রাতে ঘুমানোর আগে প্রতিদিন এক গ্লাস গরম দুধ পান করুন।
  • শরীরে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের মাত্রা ঠিক না থাকলে প্রি মেনস্ট্রুয়াল সিন্ড্রোম হতে পারে। তাই পিরিয়ডের সময় পেট ব্যথা ও অ্যাসিডিটির সমস্যা হলে খেয়ে নিন এক গ্লাস দুধ।
  • দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন যা মাংশপেশির গঠনে সহায়তা করে ও মাংস পেশির আড়ষ্টতা দূর করে। মাংসপেশির গঠন উন্নত করতেও প্রতিদিন দুধ পান করা উচিত।
  • প্রতিদিন দুধ পান করলে পাকস্থলী ঠাণ্ডা থাক, এসিডিটি দূর হয় ও বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা দূর হয়।
  • দুধে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল ও ইমিউনোগ্লোবিওলিন রয়েছে, যা দেহের ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। প্রতিদিন দুধ পানে ত্বক নরম, কোমল ও মসৃণ হয়।
  • দুধ কোলেস্টোরল নিয়ন্ত্রণে রাখে ও রক্ত পরিষ্কারের পাশাপাশি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে।
  • নিয়মিত কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার খেলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
  • নিয়মিত দুধ খেলে আর্টারিওস্ক্যারোসিস (arteriosclerosis) –এ আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচা যায়। এ রোগ হলে আমাদের আর্টারিগুলোর দেয়াল পুরু, শক্ত ও অস্থিতিস্থাপক হয়ে যায়। এতে শরীরের রক্তচলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ হয়।
  • দুধ খেলে দৃষ্টিশক্তি বাড়ে কারণ দুধে ভিটামিন-এ থাকে।
  • বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে যে পর্যাপ্ত দুধ পান মলাশয় ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক কাজ করে।

যারা সরাসরি দুধ হম করতে পারেননা তারা দই কিংবা অন্য যে কোন দুগ্ধজাত পণ্য নিশ্চিতভাবে খেতে পারেন। দুধের কার্বোহাইড্রেটকে বলা হয় ল্যাকটোজ যা হজমের জন্য ল্যাকটেজ নামক এনজাইম দরকার। যাদের দেহে যথেষ্ট পরিমাণে ল্যাকটেজ এনজাইম তৈরি হয় না, তারা দুধ হজম করতে পারেনা, এই অবস্থাকে বলা হয় Lactose intolerance। তবে দুগ্ধজাত পণ্য যেমন-দই,মিষ্টি,ঘি,মাখন,পনির ইত্যাদি খেতে কোন সমস্যা নাই। তাছাড়া অন্য কোন খাদ্য সহযোগে দুধ গ্রহণে এই সমস্যা হয় না। একজন মানুষের প্রতিদিনের চাহিদা ২৫০ মিলিলিটার দুধ। একবার ভাবুন তো আমারা একসপ্তাহে কতটুকু দুধ গ্রহন করি। ১৬ কোটি মানুষের এই জনবহুল দেশে যদি আমরা আমাদের প্রয়োজনের অর্ধেক পরিমানও নিয়মিত গ্রহন করি তাহলে আমাদের খামারীদের উৎপাদিত দুধ বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দেয়া লাগত না। তাই আসুন সুস্থ থাকতে নিয়মিত দুধ পানের অভ্যাস গড়ে তুলি।

পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বেকারত্ব দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে দুগ্ধ শিল্প বিরাট ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭৫ কোটি মানুষ গোপালক পরিবারে বসবাস করে। তাছাড়া দুধ হতে ছানা, পনির , দই, ঘোল, ল্যাকটোজ, ঘন দুধ, গুড়া দুধ, ননী, মাখন, ঘি, দই, লাচ্ছি, মালাই বা আইসক্রিম ইত্যাদি প্রস্তুত করার পাশাপাশি আধুনিক প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে আরও বিভিন্ন প্রকারের দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদন করা হচ্ছে যার সাথে জড়িত আছে বিশাল শ্রমশক্তি। বাংলাদেশের মোট শ্রম শক্তির ২০% প্রত্যক্ষভাবে ও ৫০% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদের সাথে জড়িত।
বাংলাদেশে ১৫২.০২ লক্ষ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে বার্ষিক দুধ উৎপাদন ৯৯.২৩ লক্ষ মেট্রিক টন যা দিয়ে দেশের প্রোটিন সরবরাহের প্রায় ১০%।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে প্রতিদিন অন্তত ২৮০ মিলিলিটার দুধ গ্রহণ করা উচিত। অথচ আমরা মাথাপিছু প্রতিদিন দুধ গ্রহণ করছি মাত্র ১২৫ দশমিক ৫৯ মিলিলিটার। অতএব দেশে দ্রুত দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু যথাযথ মান নিয়ন্ত্রনব্যবস্থা ও বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে না উঠার কারণে নিরাপদ দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য সরবরাহ নিয়ে যেমন ভোক্তদের আস্থার জায়গা তৈরি হয়নি তেমনি খামারিদের বিদ্যমান উৎপাদিত পন্যের মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায়নি, যা উৎপাদন বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় বাঁধা হিসেবে কাজ করছে।

অন্যদিকে ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপাদনকারী এবং দুগ্ধজাত পণ্য ও গুড়া দুধ রপ্তানিকারী দেশ। ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তাদের দুগ্ধ উৎপাদন ৩গুণ হয়েছে। শুধু তাই নয় তাদের মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে দুগ্ধ শিল্প একটি বিকাশিত ও টেকসই শিল্পে পরিণত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাজার দখল করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৯ সালে ভারতের দুগ্ধ উৎপাদন ছিল ১৯১ মিলিয়ন মেট্রিক টন যা ২০২৬ সাল নাগাদ ২২৭.৭৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন এ পৈাছাবে। আজ তাদের ৮০ মিলিয়ন পরিবার দুধ উৎপাদন কাজে নিয়োজিত থেকে স্বাবলম্বি। মাথাপিছু দুধ গ্রহণ বর্তমানে ৩৫৫গ্রাম/দিন/জন। ডেইরি ইন্ডাস্ট্রি তাদের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ভারত হল বিশ্বে সর্বোচ্চ পরিমাণে গবাদি পশু ও মহিষের দুধের উৎপাদক এবং গ্রাহক। কিভাবে সম্ভব হলো এই অসাধ্য সাধন করা? ১৫-২০ লিটার দুধের গাভী দিয়েই ইউরোপ-আমেরকিাকে পাল্লা দিয়ে বিশ্বে প্রথম হওয়া যাদের ১০০লিটার দুধের গাভী আছে, উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ ঘাস আছে, দিগন্ত প্রসারিত ঘাসের জমি?

তা জানতে ফিরে যেতে হবে ১৯৬৫ সালে যখন ইন্ডিয়ান ডেইরি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড ঘঠিত হয় যা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্টান। এরপর ১৯৭০ সালে সাদা বিপ্লব নামে প্রকল্প হাতে নেয়া হয় যার মাধ্যমে সমবায় ভিত্তিতে খামারিদের সংগঠিত করা হয়, খামারিদের টিকিয়ে রাখতে গাভী প্রতি প্রণোদনা দেয়া হয়, তাদের দুধ কিনে বাজারজাত করণের ব্যবস্থা করা হয়। নিরাপদ দুধ উৎপাদন নিশ্চিত করতে উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরনের প্রতিটি ধাপে রেগুলেশন যথাযথভাবে করা হয়। প্রাণিসেবা খাতকে জরুরি সেবার আওতায় এনে খামারিদের জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে ইউনিয়ন পর্যায়ে ভেটেরিনারি সার্ভিস সেন্টার নির্মাণ করা হয়। উন্নতমানের টিকা উৎপাদন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়। Dairy Processing & Infrastructure Development Fund (DIDF) নামে ফান্ড গঠন করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে তোলা হয় মিল্ক প্রসেসিং প্লান্ট। ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে আমূল, নন্দিনি, মাদার ডেইরি, দুধসাগর ডেইরি, ডাইনামিক্স ডেইরি, মিল্মা মিল্ক, আভিয়ান মিল্ক, সাঞ্চি মিল্ক, অম্ফিড ডেইরি, সুধা ডেইরি, ভেরকা মিল্ক, হাটসান এগ্রো, হেরিটেজ এগ্রো, কাউয়ালিটি মিল্ক, ওয়ারানা মিল্ক, ভিশাখা ডেইরি, মিল্ক মন্ত্র ডেইরি প্রভৃতি বিশ্ববিখ্যাত ব্রান্ড। সরকার খামারিদের পেছনে যা বিনিয়োগ করছে তার হাজারগুণ আজ ফিরে আসছে বিশ্ব বাজার হতে।

স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশেও একদিন গড়ে উঠবে বিশ্বজয়ী এমন দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্টান, খামারিরা পাবে ন্যায্য মূল্য এবং জনগন পাবে পর্যাপ্ত নিরাপদ দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য। সুস্থ, সবল, মেধাবি জাতিগঠন হবে বাস্তবতা। নিশ্চিত হবে ডেইরি খাতের টেকসই উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জীবিকা ও পুষ্টি। এ হোক বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ২০২০ এর অঙ্গিকার।

লেখকঃ
ডাঃ মোঃ নূরে আলম
ভেটেরিনারি সার্জন,
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, ঢাকা।
আএলএসটি, নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
nurealamdr@gmail.com




  এ বিভাগের অন্যান্য