
একটি জাতি কতটা সবল ও সুস্বাস্থের অধিকারী তার সবচেয়ে ভালো নির্ণায়ক হল সে জাতির শিশু-স্বাস্থ ও প্রাণি-স্বাস্থ। প্রাণি-স্বাস্থ্যের বা প্রাণীজ আমিষের ব্যাঘাত ঘটলে তার প্রভাব পরে শিশু-স্বাস্থ্য তথা সমগ্র মানব জাতির উপর। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত ভেটেরিনারি ডাক্তাররা প্রাণিচিকিৎসা ও প্রাণি উৎপাদন ব্যাবস্থাপনা সুরক্ষার মাধ্যমে নিরাপদ দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদনের দ্বারা এদেশের মানুষের প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী ভেটেরিনারি মেডিসিন একটি সম্মানজনক পেশা এবং বহু দেশে ভেটেরিনারি ডাক্তারদের মূল্যায়ন মানুষের ডাক্তারদের চেয়ে কম নয়, কারণ তারা বিশ্ব মানবকুলের প্রাণীজ আমিষ যোগানে গুরুত্বপূণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাণিসম্পদ সেক্টরটি বাংলাদেশে অবহেলিত এবং এর কার্যকর উন্নয়নে আমাদের সরকারগুলোকে কখনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
গত শতাব্দীর আশির দশকের পর হতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের জনবল কাঠামোতে কোন নতুন পদ সৃষ্টি বা বিদ্যামান পদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়নি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে যখন মোট জনসংখ্যা ছিল ৮ কোটি এবং গবাদিপশু-পাখির সংখ্যা ছিল ১১ কোটি (কৃষি শুমারি, ১৯৮৩-৮৪), তখন প্রতি উপজেলাতে ১ জন করে ভেটেরিনারি সার্জন ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা পদ বন্টন করে প্রাণিসম্পদ সেক্টরে প্রথম অর্গানোগ্রাম (জনবল কাঠামো) গঠিত হয়। আজ প্রায় ৪ দশক পর দেশের জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৭ কোটি এবং গবাদিপশু-পাখির সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৪০ কোটি (সূত্র: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের রিপোর্ট) হয়েছে, অথচ এই বিস্ফুরিত জনসংখ্যার প্রাণীজ আমিষের ঘাটতি মেটাতে বর্ধিত গবাদি পশু-পাখির স্বাস্থ সুরক্ষায় মাঠ পর্যায়ে অতিরিক্ত জনবল সংকুলানের কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কাজেই, বর্তমানে ১ জন ভেটেরিনারি সার্জন দিয়ে একটি উপজেলার ৬-৭ লক্ষ গবাদি পশুপাখির সুচিকিৎসা কতটুকু নিশ্চিত করা যাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয় !
ওই অর্গানোগ্রাম হওয়ার সময় এদেশে শুধু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এর ভেটেরিনারি সাইন্স অনুষদ থেকে প্রতি বছর ৫৫ জন ভেটেরিনারি ডাক্তার বের হতো। কালের পরিক্রমায় বর্তমানে বাংলাদেশের ৮ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ১ টি সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ হতে প্রতি বছর প্রায় ১০০০ জন ভেটেরিনারি ডাক্তার বের হচ্ছে, এবং গত ৩ বছরে আরো ৪ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে ভেটেরিনারি সাইন্স কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এই বিশাল সংখ্যক ভেটেরিনারি ডাক্তারদের কর্মসংস্থানের কোন পদক্ষেপ বস্তুত দৃশ্যমান নয়।
ফলস্বরূপ, এই সেক্টরের পাশকৃত হাজার হাজার গ্রাজুয়েটদের আজ কোন চাকরি নেই, চাকুরীর প্রত্যাশায় হণ্য হয়ে তারা রাস্তায় ঘুরছে। অথচ এই বেকার ভেটেরিনারি ডাক্তারদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের পশুপাখির সুচিকিৎসা ও ব্যাবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদের আমূল উন্নয়নের সুযোগ ছিল।
উল্লেখ্য, দেশের ক্রমবর্ধমান মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য শস্য, শাকসবজি ও ফলমূলের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে এবং মাছের চাহিদা মিটাতে মৎস্য অধিদপ্তরে মাঠ পর্যায়ে অধিক সংখ্যক কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করে গত ২০১৪ সালে নতুন অর্গানোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যা বর্তমান সরকারের একটি সুদূরপ্রসারী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ফলস্বরূপ, এখন সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়, আর চাল ও মাছ উৎপাদনে চতুর্থ (সূত্র: কৃষি সম্প্রসারণ এবং মৎস্য অধিদপ্তর)।
পক্ষান্তরে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের উপাত্ত মোতাবেক দুধ ও ডিমের বাৎসরিক উৎপাদন যথাক্রমে ৯৪.০৬ লক্ষ মেট্রিক টন এবং ১৫৫২ কোটি। এবং দুধ ও ডিমের বাৎসরিক ঘাটতি যথাক্রমে ৫৬.২৩ লক্ষ মেট্রিক টন ও ১৬০.৮৮ কোটি। দুধের বর্তমান উৎপাদন বাৎসরিক চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশের চেয়েও কম (৬২.৫৮ %)। পরিণামে, বিদেশ থেকে নিম্নমানের গুঁড়ো দুধ আমদানি করে আমাদের চাহিদা মিটাতে হচ্ছে। পাশাপাশি গরুর মাংসের দাম বেড়ে কেজি প্রতি ৫৫০ টাকা ছাড়িয়েছে।
মূলত, আমাদের অধিকাংশ খামারিরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছোট্ট পরিসরে হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষের খামার করছে; কিন্তু সকলে লাভবান হতে পারছে না-কেউ কেউ হচ্ছেন নিঃস্ব। কারণ, ভেটেরিনারি ডাক্তারের পরামর্শ ব্যাতিত ভুল চিকিৎসা ও অব্যবস্থাপনার দরুন বিভিন্ন সময় তাদের খামারে ঘাতক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব মহামারী আকার ধারণ করছে। কাজেই, আমাদের বিশাল বেকার-দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি লালন পালনে উদ্বুদ্ধ করন সহ প্রয়োজোনীয় ভেটেরিনারি সেবা নিশ্চিত করতে হবে। তাতে একদিকে আমাদের খামারিরাই যেমন দেশের দুধ, ডিম ও মাংসের চাহিদার শতভাগ পূরণ করবে; অন্যদিকে, এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি তথা বেকারত্ব ঘোচানোর এক উৎকৃষ্ঠ পন্থা হবে। কিন্তু, সরকার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে মাঠ পর্যায়ে জনবল কাঠামো বৃদ্ধি করে ভেটেরিনারি সেবা বিস্তারের কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
এতে কে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ? সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে তাদের পশুপাখির স্বাস্থ সেবা থেকে, আর দেশ বঞ্চিত হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে। প্রাণিসম্পদ অদিধপ্তর কর্তৃক প্রস্তাবিত একটি নতুন অর্গানোগ্রাম অর্থমন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন ধরে অজানা কারণে আটকে ছিল। অর্গানোগ্রামটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বেকার ভেটেরিনারি ডাক্তারদের কর্মসংস্থান করে প্রান্তিক ক্ষুদ্র খামারিদের দোরগোড়ায় ভেটেরিনারি সেবা নিশ্চিত করতে পারলে- সবজি, চাল ও মাছের ন্যায় নিরাপদ দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদনেও দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা সম্ভব।
আমাদের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ প্রত্যক্ষ এবং ৪৫ শতাংশ পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের উপর নির্ভরশীল (সূত্র: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের রিপোর্ট)। ফলে প্রাণিসম্পদ সেক্টরে জনবল নিয়োগের যে বন্ধ্য অবস্থা চলছে, তা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের কাঙ্খিত উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে। আগামী ২০৪১ সালে স্বপ্নের উন্নত বাংলাদেশে সুস্থ-সবল ও মেধাবী উন্নত বাঙালি জাতি দেখতে চাইলে- প্রয়োজন নিরাপদ দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি টেকসই সমৃদ্ধশালী প্রাণিসম্পদ সেক্টর।
কাজেই, সরকারের উচিত প্রতি উপজেলায় এন্ট্রি-লেভেলে কমপক্ষে ৫ টি করে ভেটেরিনারি সার্জন পদ সংবলিত নতুন অর্গানোগ্রাম পাশ করে খামারিদের নিকট ভেটেরিনারি সেবা সহজলভ্য করা।
ড. এম এ হান্নান
পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক
অবিহিরো ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচার এন্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন
জাপান
Email: m.hannan1984@gmail.com