www.agribarta.com:: কৃষকের চোখে বাংলাদেশ
শিরোনাম:

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গ


 সম্পাদকীয়    ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ১১:০৮   সম্পাদকীয় বিভাগ


প্রায় সাত-আট শত বছর পূর্ব হতে ইউরোপেই প্রথম আধুনিক বৈশিষ্ট্যের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। এদের মাঝে বোলোনা (১০৫০), প্যারিস (১১৫০), অক্সফোর্ড (১১৬৭), নেপলস (১২২৪) ও কেম্ব্রিজ (১২৩৯) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ঐ সময়ের প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধির জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পাদপীঠ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকবৃন্দ যুগ-সঞ্চিত জ্ঞান-ভান্ডার হতে জ্ঞান আহরণ করে তা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করতেন। শিক্ষার্থীরা এই জ্ঞান পেয়ে মুক্ত চিন্তার ও উচ্চমানের মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতেন।

মুক্ত-চিন্তা চর্চার কেন্দ্র হওয়ার কারনে মাঝে মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সাথে রাজাদের মতবিরোধ সৃষ্টি হত। এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অনেক সমস্যায় পড়তে হত। এমনি পরিস্থতিতে কখনও কখনও শিক্ষকরা চাকুরী ছাড়তে বাধ্য হতেন। উদাহরণ স্বরূপ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা যায়। এই বিশ্ববিদ্যালয় একাধিক সময় রাজাদের কোপানলে পড়েছে। রাজা অষ্টম হেনরির (১৪৯১-১৫৪৭) বিয়েসহ একাধিক কর্মকান্ডের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দ্বিমত পোষণ করায় রাজা ক্ষেপে যান এবং ১৫৩৫ সালে শিক্ষকদেরকে রাজার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে আদেশ দেন। রাজা প্রথম এডওয়ার্ড (১৫৪৭-১৫৫৩) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। আবার রানী মেরীর সময়ে (১৫১৬-১৫৫৮) ক্যাথলিক মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। রানী প্রথম এলিজাবেথ (১৫৩৩-১৬০৩) বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি-বিধান প্রদানের ক্ষমতা শিক্ষকদের কাছ হতে নিয়ে উপাচার্য্য ও কলেজের প্রধানদের উপর অর্পন করেন। এতে করে রানীর পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। এধরনের আরও উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের সীমারেখা কতদূর হবে তা নিয়ে সব সময় বিতর্ক ছিল। এই বিতর্ক বেশী গুরুত্ব পেতে থাকে বিংশ শতাব্দীতে এসে। Sir James Mountford ১৯৬৬ সালে British Universities শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। উক্ত গ্রন্থে স্বায়ত্তশাসনের আলোচনায় তিনি বলেছেন - শিক্ষার্থী নির্বাচন, শিক্ষক নির্বাচন, পাঠ্যক্রম স্থির করা ও ডিগ্রীর মান ঠিক রাখা, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃতির সীমা নির্ধারনের ক্ষমতা, পাঠ-পঠন, গবেষণা ও প্রকাশনা, প্রয়োজন বোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন খাতে ব্যয় করার স্বাধীনতা বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকতে হবে।

International Association of Universities (IAU) একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংস্থা। এই সংস্থাটি UNESCO এর অফিসিয়াল পার্টনার। IAU বিশ্বের ১৩০ টি দেশে কাজ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৬৫০ টি বিভিন্ন ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা এর সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সীমারেখা নির্ধারনের জন্য IAU একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি ১৯৬৩ সালে রিপোর্ট প্রদান করে। ১৯৬৫ সালে IAU কমিটির রিপোটর্টি গ্রহণ করে। উক্ত রিপোর্টে বলা হয় নিম্ন লিখিত বিষয়গুলির উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা থাকতে হবেঃ

    The university should have the right to select its own staff.
    The university should be responsible for the selection of its students.
    University should be responsible for the formulation of curricula for each degree and for the setting of academic standards.
    Each university should have the final decision as to the research programme carried within its walls.
    The university should be responsible for the allocation, among its various activities, i.e., space and equipment, capital funds and recurrent operating revenue.

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করার জন্য শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী, মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ঐ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে ২১ টি দফা ছিল। ইশতেহারের ১১-নম্বর দফাটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্বায়ত্তশাসনের দাবী। ১১-নম্বর দফার ভাষা ছিল নিম্নরূপঃ ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালা কানুন বাতিল করে স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরকরণ (ঐ সময় ২টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল)।

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান অবৈধ ভাবে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তিনি ১৯৬১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের Act এ স্বায়ত্তশাসন বিরোধী কয়েকটি নতুন ধারা যোগ করেন। একটি ধারায় বলা হয় চ্যান্সেলর (পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর) মনে করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন কমিটি বাতিল, কমিটির সদস্যকে অপসারণ এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে বরখাস্ত বা অপসারণ করতে পারবেন। আরেকটি ধারায় বলা হয় চ্যান্সেলর যাকে ইচ্ছা তাকেই ভিসি হিসাবে নিয়োগ দিতে পারবেন। এই ক্ষমতা বলে চ্যান্সেলর অনুগত ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে পারতেন। ভিসি মহোদয়কে একটি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। এই ক্ষমতা বলে ভিসি ইমারজেন্সি দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোন কার্য্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন।

১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে শুধু ঢাকা, রাজশাহী ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ঐ সময় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের এই আইনকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষের শিক্ষক ও ছাত্ররা কালো কানুন হিসাবে অভিহিত করেন এবং এই আইন বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের আন্দোলন গড়ে তুলেন। এই আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীরাও সমর্থন জানিয়েছিলেন।

১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ ৬-দফার আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাঁকে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলানোর প্রস্তুতি নেয়। ক্যান্টনমেন্টের ভিতর গোপনে এই মামলার কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারী মাসে ছাত্র সমাজ বাঙ্গালী জাতির মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক ১১-দফা আন্দোলনের দাবীনামা প্রকাশ করে। দাবীনামার শিরোনাম ছিল “জাতির মুক্তি-সনদঃ ছাত্রদের এগার দফা।”

এই দাবীনামার ১(ত) দফায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দাবী। দফার ভাষা ছিল নিম্নরূপঃ
১(ত): কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিনেন্স সম্পূর্ণ বাতিল করিতে হইবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করিতে হইবে।

১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ১১-দফা আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধু জেলখানা হতে মুক্তি পান, ছাত্ররা তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন এবং আইয়ুব খানের পতন হয়। ১৯৭০ সালের ৬ ই জানুয়ারী আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়, উক্ত অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ঐ কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ ছাত্রদের ১১- দফা গ্রহণ করে (১ত. দফাসহ)।

শুধু তাই নয় আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে ৬-দফার সাথে ১১-দফাকে নির্বাচনী প্রচারের অংশ করেছিল। ৭ই ডিসেম্বরের নির্বাচনের প্রাক্কালে ১লা ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরে নির্বাচনী ইশতেহার প্রচারিত হয়। উক্ত ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু বলেন ..“রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে যে আন্দোলন তারা (জনগণ) গড়ে তুলেছিল সে আন্দোলন ৬-দফা ও ১১-দফার। আমি তাদেরই ভাই। আমি জানি ৬-দফা, ১১-দফা বাস্তবায়নের পরই তাদের বিদেহী আত্মা শান্তিপাবে। ...... নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে প্রতিটি আসনে জয়যুক্ত করে আনুন।” উক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল। ৫৪ ও ৭০ সালের নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের সরকারের দায়িত্ব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কায়েম করা। কারন জনগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশানের পক্ষে ভোট দিয়ে যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করেছিল।

যে দাবীটি ৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারে ছিল (১১নং-দফা), যে দাবীটি ছাত্রদের ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনের ১১-দফায় ছিল ( ১ত), যে দাবীটি ৭০ এর নির্বাচনের ইশতেহারে ছিল (বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত নির্বাচনী প্রচার পত্র, ১/১২/১৯৭০) সেই স্বায়ত্তশাসনের দাবীটি কার্যকর করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। এত দিনেও দাবীটি কায়েম না হওয়ায় দেশবাসী ক্ষুব্ধ, হতাশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তসনের দাবীটির একটি আইনী ও নৈতিক অবস্থান আছে। নির্বাচনী ইশতেহারের অন্তর্ভূক্ত একটি দাবী কোন সরকারেই ৬৫ বৎসর ফেলে রেখে, কায়েম না করে, উল্টো পথে হাঁটতে পারেনা। জনগণ এর কারন জিজ্ঞাসা করার অধিকার রাখে। জনগণ ৫৪ ও ৭০ এর সাধারন নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠন করেছিল। এখনও ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। তাই ৬৫ বছরের পুরাতন দাবীটি কায়েম করার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ সরকারের উপরে বর্তায়। যদি সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তাহলে রাজনীতির ঐতিহ্য (কনভেনশন) অনুসারে বিষয়টির উপরে গণভোট (referendum) হওয়া উচিত।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালসমূহের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি ভুলেননি। তাই তিনি ১৯৭৩ সালে ৪ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন আইনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন দেন। স্বাধীনতার শত্রুরা ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা না করলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি স্বায়ত্তশাসনসহ অনেক কিছু পেত।

যারা ষাটের দশকের উত্তাল তরঙ্গের দিনগুলি স্বচক্ষে দেখেনি, যারা ঐ সময়ে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি অথবা যারা ঐ সময়ের ইতিহাস পড়েনি তাদের কাছে মনে হতে পারে শিক্ষকদের স্বায়ত্তশাসনের দাবীটি নতুন-ইদানিং কালের। তা কিন্তু নয়। এই দাবী ৬-দফা আন্দোলনের সহযোগী-সহগামী। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের ১১ দফা গ্রহণ করে এই দাবী কার্যকর করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার পর তিনি এই প্রতিশ্রুতি আংশিকভাবে কার্যকর করেছিলেন।

স্বায়ত্তশনের বিরুদ্ধে যাওয়ার অর্থই হল বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত নীতিকে অস্বীকার করা- প্রকারন্তরে বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করা। বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অনুসারীরা তা করতে পারেন না।

প্রফেসর ডঃ মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম
সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।




  এ বিভাগের অন্যান্য