আবহাওয়ার পূর্বাভাস সেবার বাইরে ৯৫ শতাংশ কৃষক

কৃষি উৎপাদনে আবহাওয়ার সঠিক পূর্বাভাস গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশের জন্য এটা আরো জরুরি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা ও খরায় প্রতি বছর দেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্যশস্য বিনষ্ট হচ্ছে। এ ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনে আবহাওয়ার সঠিক তথ্য কৃষককে পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক আবহাওয়া পূর্বাভাসভিত্তিক কৃষি পরামর্শ সেবা গ্রহণ করছেন। অথচ বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। এক্ষেত্রে উৎপাদন ক্ষতি এড়াতে আবহাওয়া সতর্কীকরণ ব্যবস্থা জোরদার এবং সব কৃষককে এ সেবার আওতায় আনতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
বর্তমানে দেশের কৃষি খাতে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঘূর্ণিঝড়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে গেছে। বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হয়ে গেছে। যখন হওয়ার কথা তখন কম হচ্ছে, আবার যখন হওয়ার কথা নয় তখন বেশি হচ্ছে। জলবায়ুর খামখেয়ালিপনায় কৃষি উৎপাদন নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে বাড়ছে খরার প্রকোপ। দক্ষিণাঞ্চলে বাড়ছে লবণাক্ত জমির পরিমাণ। হাওরাঞ্চলে আবার আকস্মিক বন্যার অভিঘাত একটা সাংবৎসরিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এতে হঠাৎ করে তলিয়ে যাচ্ছে পরিপক্ব ফসল। সার্বিকভাবে অতিরিক্ত তাপ ও আর্দ্রতা খাদ্যশস্যের গাছে ছত্রাকের আক্রমণ বাড়াচ্ছে। ফলনে ফেলছে নেতিবাচক প্রভাব। ফলে দেশের কৃষিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বের করে আনার বিকল্প নেই। একে অস্বীকার করা যাবে না, কিন্তু আগাম পূর্বাভাসের মাধ্যমে দুর্যোগ এড়ানো সম্ভব। সেক্ষেত্রে আবহাওয়ার পূর্বাভাস সেবার প্রসার প্রয়োজন। বাস্তবতা হলো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ও কৃষি বিষয়ে কৃষকদের আগাম তথ্য দিতে সরকার সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে আবহাওয়া তথ্য বাতায়ন বোর্ড চালুর উদ্যোগ নেয়। এজন্য প্রতিটি ইউনিয়ন কৃষি অফিসে ট্যাবসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বসানো ছাড়াও একজন করে লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দুই বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও প্রাতিষ্ঠানিক শৈথিল্য ও উদাসীনতায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উপজেলায় আবহাওয়া তথ্য বোর্ড কার্যকর হয়নি। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে কৃষিকে ঝুঁকিমুক্ত করতে আগাম পূর্বাভাস সুবিধা পাচ্ছেন না অধিকাংশ কৃষক। এতে ফসল বোনা থেকে শুরু করে উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপে কৃষক এখনো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
আমরা দেখছি টেকসই কৃষি উৎপাদন নিশ্চিতে বিভিন্ন দেশ প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ জাপান কৃষি খাতকে পুরোপুরিভাবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করেছে। মৌসুমভিত্তিক আবহাওয়ার বিজ্ঞানসম্মত তথ্য সহজেই জানতে পারছেন সে দেশের কৃষক। কোন এলাকায় কখন বৃষ্টি হবে, একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কত থাকবে, কোথায় কোন সময় টাইফুন বা সুনামি হতে পারে, তার সঠিক পূর্বাভাস তারা পাচ্ছেন শক্তিশালী প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জাপানি কৃষকরা ফসল বুনছেন, খাদ্যশস্যে বালাইনাশক ছিটাচ্ছেন, সেচ দিচ্ছেন এবং সঠিক সময়ে ফসল কাটছেন। সঠিক তথ্য পাওয়ার কারণে তারা যেমন সময়মতো উৎপাদন করতে পারছেন, তেমনি লক্ষণীয় মাত্রায় ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছেন। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাজিলেও কৃষকদের আবহাওয়ার পূর্বাভাস সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। চীনেও এ ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার ও দক্ষ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে দেশগুলো এ ধরনের সেবা দিচ্ছে কৃষকদের। দেশগুলোর অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।
একথা সত্য যে দেশের আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবস্থা আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। সঠিকভাবে বৃষ্টিপাত, কুয়াশা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি সম্পর্কে আগাম পূর্বাভাস দেয়া যাচ্ছে। এটা ইতিবাচক বিষয়। কিন্তু মুশকিল হলো, কৃষিকে এ পূর্বাভাস ব্যবস্থার সঙ্গে এখনো পুরোপুরি একীভূত করা যায়নি। কৃষিকে ঝুঁকিমুক্ত করতে সরকার উপজেলাভিত্তিক আবহাওয়া তথ্য বোর্ড গড়ে তোলার একটা উদ্যোগ নিলেও অনেক জায়গায় তা কার্যকর হয়নি। এটাকে কার্যকর করতে হবে। তথ্য বোর্ডকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও লোকবলে সুসজ্জিত করতে হবে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আবহাওয়া-সংক্রান্ত তথ্য কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যাতে তারা ওই তথ্যের ভিত্তিতে চাষাবাদের ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারেন। দেশের প্রতিটি কৃষক এখন সেলফোন ব্যবহার করছেন। এক্ষেত্রে প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কৃষকদের কাছে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাস পৌঁছে দেয়া কঠিন নয়। জাপান মোবাইল রেডিও ও মোবাইল ফোনকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস পৌঁছে দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশে কয়েকটি সেলফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি রেডিও এ সেবা দিলেও তার কিছু সীমাবদ্ধতা এরই মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। বড় সীমাবদ্ধতা হলো, অধিকাংশ পূর্বাভাস স্বল্পমেয়াদি, অর্থাৎ সাতদিন বা ১৫ দিন আগের আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যায়। কিন্তু এক মাস বা তার বেশি আবহাওয়ার পূর্বাভাস মেলে না। এক্ষেত্রে আবহাওয়ার নিখুঁত পূর্বাভাস যেমন নিশ্চিত করা জরুরি, তেমনি সেলফোনের মাধ্যমে কীভাবে সুলভে ও সহজে কৃষকের কাছে সতর্কবার্তা পৌঁছে দেয়া যায়, তার পথ খুঁজে বের করতে হবে।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতা আরো বাড়বে। কাজেই এর অভিঘাত মোকাবেলায় কৃষি ও কৃষককেও প্রস্তুত করে তুলতে হবে। সন্দেহ নেই, দেশের প্রধান খাদ্যশস্য হলো ধান, যা আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি কৃষি সম্প্রদায়ের জীবিকার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। সংগত কারণে এমন জাতীয় কৃষিনীতিতে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মাধ্যমে কৃষকদের পরামর্শ দেয়ার জন্য সতর্কীকরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারও এরই মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে। সেগুলো আরো বেগবান করতে হবে। কৃষির বর্তমান বিরূপ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ব্রির উদ্যোগে কৃষি আবহাওয়া ও ক্রপ মডেলিং ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠার খবর মিলছে। এর মাধ্যমে পূর্বাভাসের ডাটা প্রক্রিয়াকরণ, মূল্যায়ন, কৃষকদের আবহাওয়ার পূর্বাভাসভিত্তিক ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও পরামর্শ সেবা প্রস্তুত এবং প্রচারের জন্য একটি ওয়েবভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় প্লাটফর্ম ‘ইন্টিগ্রেটেড রাইস অ্যাডভাইজরি সিস্টেম’ তৈরি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সমন্বয়ে এ প্লাটফর্মকে কার্যকর করে তুলতে হবে। শুধু ধান নয়, অন্য খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্যও আবহাওয়ার প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা সার্বিকভাবে ঢেলে সাজাতে হবে বৈকি।
জিডিপিতে অবদান ক্রমান্বয়ে কমলেও দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষি এখনো অপরিহার্য। সুতরাং এটিকে সুরক্ষিত করতে হবে। সেজন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা থেকে দেশের কৃষিকে বের করে উৎপাদনশীল আধুনিক কৃষির দিকে ধাবিত করতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে আমাদের গতানুগতিক কৃষি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আরো গতিশীল কৃষির দিকে যাত্রা করতে হবে, জলবায়ুবান্ধব কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। কৃষি উৎপাদনে শক্তিশালী প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন ছাড়া ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্ভব নয়। সরকারের জোরালো প্রচেষ্টায় দ্রুতই এক্ষেত্রে উন্নতি হবে এমনটাই প্রত্যাশা।