
বাংলাদেশের প্রায় ৩৯ শতাংশ মানুষ এখন শহরে বসবাস করে। সেদিক থেকে এ দেশকে যতই আধাশহুরে জনগোষ্ঠীর দেশ বলে মনে করা হোক না কেন, আসলে এ দেশের সিংহভাগ মানুষের সংশ্লিষ্টতা এখনো গ্রাম ও কৃষির সঙ্গেই অধিক নিবিড়। এমনকি স্থায়ীভাবে শহরে বসবাসকারী মানুষের একটি বড় অংশ এখনো কোনো না কোনোভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাদের অনেকের পরিবারের কোনো কোনো সদস্য এখনো গ্রামেই বসবাস করেন এবং সেক্ষেত্রে হয় তাদের আয়-উপার্জনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রাম থেকে আসে অথবা শহরের আয়ের একটি বড় অংশ গ্রামে চলে যায়। মোটকথা, বসবাসের সংখ্যাগত বিচারে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী যতই শহর ও গ্রামে প্রায় আধাআধি অবস্থায় বিভাজিত থাকুক না কেন, প্রকৃত পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যুক্ততা এখনো গ্রাম ও কৃষির সঙ্গেই অধিক। ওই যে ঈদের সময় যানবাহনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও শহরের মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে গ্রামের দিকে ছুটে যায়, সেটা ওই যুক্ততারই প্রমাণ বহন করে। মোটকথা, গ্রাম ও কৃষিই এখন পর্যন্ত এ দেশের মানুষের জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা ও আচার-আচরণকে চালিত করছে। আর সে কারণেই এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ঐতিহ্যিক সূত্রে গ্রাম ও কৃষিকে যত সহজে ও যতটা ভালোভাবে বোঝে আর কিছুকে সে ততটা বোঝে না, শিল্পকে তো নয়ই।
এ অবস্থায় মানুষ যখন কৃষি ছেড়ে বা কৃষির পাশাপাশি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, তখন প্রথমেই তাকে মোকাবেলা করতে হয় পেশাগত অপরিচয়ের বাধা; অর্থাৎ এ খাতের দক্ষতা, দক্ষতার প্রয়োগ কৌশল, উৎপাদন পদ্ধতি, বিপণন কার্যক্রম, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সবকিছুই তার কাছে নতুন বা অবোধগম্য বলে মনে হয়। ফলে এসবের সঙ্গে যুক্ত হবার ব্যাপারে তার মধ্যে পরিবর্তিত আকাঙ্ক্ষাভিত্তিক প্রচেষ্টা থাকলেও এক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ অংশগ্রহণ প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ তার পূর্বপুরুষদের প্রায় কেউ-ই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ফলে শিল্প গড়তে হলে কী করতে হয় বা কীভাবে তা করতে হয়, সেসব এর আগে সে আর কখনো দেখেনি। এ অবস্থায় খুব স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে অন্ধ অনুকরণ প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, যেটি আপাতত তাকে পথ দেখালেও খুব স্বাভাবিকভাবেই ওই অচেনা পথে সে খুব বেশি দূর এগুতে পারে না বা পথ চলতে গিয়ে প্রায়ই হোঁচট খায়।
এ সূত্রে এখানে বাংলাদেশের শিল্প খাতের প্রারম্ভিক যাত্রার ইতিহাসের প্রতি খানিকটা দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। এখানে প্রথমেই উল্লেখ্য, এটি শুরু হয়েছিল ১৯৭১-এ পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি মালিকদের ফেলে যাওয়া শিল্প-কারখানাগুলো রাষ্ট্রের অনুকূলে অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে (এটিই ছিল একমাত্র বিকল্প); অর্থাৎ ওই শিল্প-কারখানাগুলো এ দেশের কোনো উদ্যোক্তার নিজস্ব প্রচেষ্টার ফসল ছিল না। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার আগে বাঙালি মালিকানায় মাঝারি পর্যায়ের যেসব শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছিল, স্বাধীনতার পর সেগুলোও রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তাবৃত্তির বিষয়টি বলতে গেলে একেবারেই স্থবির হয়ে পড়ে। তাছাড়া শিল্প খাতে যেকোনো বড় বিনিয়োগ শুধু রাষ্ট্রীয় খাতে হবে, সে সময়ে সেটাই ছিল নীতি। ফলে সে অবস্থায় বেসরকারি খাতে উদ্ভাবনাময় শিল্প স্থাপনের চিন্তাভাবনার কোনো সুযোগই ছিল না।
পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫-৯০ মধ্যবর্তী সামরিক শাসনামলে দেশে সম্পদ আহরণের কৌশলটি মূলত পানির দরে রাষ্ট্রীয় সম্পদ কিনে নেয়া তথা তা কুক্ষিগতকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আরো পরে ১৯৯১-২০০০ মধ্যবর্তী সময়ে দেশে প্রথমবারের মতো কিছুটা গণতান্ত্রিক আবহ তৈরি হলে সেই সুবাদে দেশে সৃজনশীল উদ্যোক্তাবৃত্তির কিছু সুযোগও তৈরি হয়। কিন্তু ২০০১ সাল থেকে অদ্যাবধি দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি বণিকবৃত্তি (ট্রেডিং) ও মুনাফার হাতে বন্দি হয়ে পড়লে এবং দেশের শিল্পোন্নয়নসংক্রান্ত নীতিমালায় উৎপাদনশীল (ম্যানুফ্যাকচারিং) শিল্পের পরিবর্তে সেবা খাতই অধিক মনোযোগ পেতে শুরু করলে উদ্ভাবনাময় নতুন শিল্প খুব একটা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। এমনকি এর ফলে গতানুগতিক ধারার শিল্পও বণিক বৃত্তিক বেচাকেনা ও সেবা খাতের দাপটে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এতে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বাড়তি গতি পেলেও মৌলিক শিল্পের বিকাশ ঘটেছে খুব ধীরে এবং রাষ্ট্রের বিনিয়োগ নীতিমালায়ও উদ্ভাবনাময় মৌলিক শিল্পকে উত্সাহদানের তেমন ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
আবার প্রথমোক্ত বিষয়টির আলোচনায় আসা যাক। কৃষি থেকে শিল্পে রূপান্তর-যাত্রার প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষির প্রতি এক ধরনের পিছুটান শুধু যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই ঘটছে এমন নয়। পৃথিবীর যেসব দেশ শিল্পোন্নয়নের পথে এরই মধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, এ পথে যাত্রার প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটেছিল। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের মূল পার্থক্য হচ্ছে শিল্প ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর প্রায় কেউ-ই শুরুতে অন্ধ অনুকরণের পথে হাঁটেনি, উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতাই ছিল এক্ষেত্রে তাদের মূল সম্পদ। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের মতো উদ্ভাবনা দিয়ে যেমন ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের যাত্রা, তেমনি একান্ত নিজস্ব কারিগরি নৈপুণ্য ও দক্ষতা দিয়েই জাপান বা চীনের মতো প্রাচ্যদেশগুলোয় ভিন্ন ধারার শিল্পোন্নয়ন প্রচেষ্টা। কিন্তু শিল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ একেবারে গোড়া থেকেই অনেকটা অনুকরণমুখী। ফলে এখানে শিল্পের কোনো নিজস্ব ধারা যেমনি গড়ে উঠতে পারেনি, তেমনি বিকাশ লাভ করেনি আধুনিক ধাঁচের উন্নততর কারিগরি দক্ষতারও। এ অবস্থায় এ দেশে কৃষি-উত্তর অর্থনীতির মূল নির্ভরতাই হয়ে দাঁড়িয়েছে বণিকবৃত্তি-উৎপাদনশীল শিল্প নয় কিছুতেই। আর মুক্তবাজারের এ যুগে এ রকম বণিকবৃত্তিনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সাময়িকভাবে কিছুটা ভোগবাদী উষ্ণতা দিলেও দীর্ঘময়াদে সেটি কতটুকু টেকসই হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায় এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বস্তুত সে দোলাচলেই ভুগছে।
সে যা হোক, মোদ্দা বিষয় হলো, বাংলাদেশের শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা এ পর্যন্ত যতটুকু এগিয়েছে, তার বেশির ভাগটাই (সবাই নন) হয়েছে অনুকরণ করে। সৃজনশীল ও নতুনতর উদ্ভাবনামূলক উদ্যোগের উপস্থিতি এ খাতে প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে দেখাদেখির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এসব গতানুগতিক উদ্যোগ থেকে প্রাপ্ত পণ্য স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণে উপযুক্ত মনে হলেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি, যে কারণে তৈরি পোশাকের বাইরে অন্যান্য খাতে রফতানির পরিমাণ খুবই ধীরগতিতে বেড়েছে। আর তৈরি পোশাক যেকোনো উদ্ভাবনাময় পণ্য নয়, সে তো কম-বেশি সবারই জানা কথা। তদুপরি এ খাতে ব্যবহূত আমদানীকৃত কাঁচামালের মূল্য বাদ দিলে এতে নিট মূল্যসংযোজনের হার খুবই সামান্য। সুতরাং সে বিবেচনা থেকেও দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনায় তৈরি পোশাক খাত নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে আশাবাদী হওয়ার খুব একটা সুযোগ নেই।
বর্ণিত প্রেক্ষাপটে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, মৌলিক ও সৃজনশীল পণ্যের বিকাশ কি তাহলে বাংলাদেশে সহসা ঘটবেই না? এক্ষেত্রে আশাবাদী জবাব পেতে হলে সর্বাগ্রে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ নীতিমালা তথা শিল্পোন্নয়ন পরিকল্পনা ও কৌশলকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। আর নতুন সে পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে উৎপাদনমুখী মৌলিক শিল্পকে এবং কোনোভাবেই সেবামূলক কার্যক্রমকে ‘শিল্প’ নাম দিয়ে তাকে উৎপাদনমুখী শিল্পের সমান্তরালে স্থাপন করে দেয়া যাবে না, যা শিল্পনীতি-১৯৯১ প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সে সময় থেকেই চলে আসছে। এ ৩১ বছরের মধ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় একাধিকবার রাজনৈতিক পালাবদল ঘটলেও উৎপাদনশীল শিল্পের তুলনায় বণিকবৃত্তিকে অগ্রাধিকারদানের নীতিমালা একই ধারায় ও গতিতে অব্যাহত এখনো অব্যাহত আছে। আর এটি ভিন্নতর আলোচনা হলেও এ সূত্রে বলা প্রয়োজন, এ ধরনের রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কারণেই বস্তুত সম্পদের মেরুকরণ ও বৈষম্য আজ এরূপ চরমরূপ ধারণ করেছে।
যা হোক, দেশে উদ্ভাবনাময় শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হলে তথা শিল্প খাতে উদ্ভাবনা ও সৃজনশীলতাকে উত্সাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে হলে এজন্য উপযুক্ত প্রণোদনা তহবিল ও অন্যান্য উত্সাহব্যঞ্জক কাজ হাতে নিতে হবে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সবাই এখন বলছেন, শিক্ষিত তরুণদের উচিত চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা হওয়া। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, উদ্যোক্তা হওয়ার লক্ষ্যে ওই মেধাবী শিক্ষিত তরুণের জন্য এমন কী ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যার আকর্ষণে সে নিজেকে গবেষণাগারে বা জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত রাখার পরিবর্তে উদ্যোক্তাবৃত্তিতে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে আকর্ষণ বোধ করবে? এমন ব্যবস্থার ধারেকাছেও আমরা নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশে যদি সত্যি সত্যি একটি মেধাভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হয় তাহলে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় যেমনি, তেমনি উদ্যাক্তাবৃত্তির জন্যও মেধা আকর্ষণমূলক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। আর সে নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়নে নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি সৃষ্টিশীল ও উদ্ভাবনাময় শিল্পোদ্যোগের জন্য সহায়ক তহবিলও গড়ে তুলতে হবে। আর ওই তহবিলের সুবিধা ব্যবহার করে মেধাবী গবেষকের আবিষ্কারকে মেধাবী উদ্যোক্তা তার উদ্ভাবনা ও সৃজনশীলতা দিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষকে একটি সমৃদ্ধ সমাজের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এ দ্বিবিধ অবস্থার কোনোটিই বর্তমানে দেশে চালু নেই। আর বণিকপ্রাধান্যযুক্ত রাষ্ট্রকাঠামোয় এটি না থাকাই স্বাভাবিক। তাই বলে এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো চেষ্টাই কী আমরা করব না, এ দেশের অযুতসংখ্যক মেধাবী তরুণ গবেষক ও উদ্যোক্তার সামর্থ্য ও সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে হলেও?
আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক, বিসিক