
বাড়ি কোথায় উত্তর সিলেট হলে তার প্রতিউত্তরে লন্ডনী শুনা প্রায় স্বাভাবিক ব্যাপার। ডেইরী খামারের ক্ষেত্রেও তার প্রভাব দেখা যায়। অন্য এলাকায় কোন খামারে গেলে হয়তো আপনাকে বলবেন, দুইটি গরু থেকে আস্তে আস্তে বড় খামার হয়েছে। কিন্তু সিলেটে আপনি কোন খামারে গেলে বলবে কোন গাভীটি কত টাকা দিয়ে কিনেছি । মানে খামারের সবগুলো গাভীই ক্রয় করা। গাভী কেনার পর সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় ঘাস। সিলেটে উন্নত প্রজাতির ঘাস রংপুর সিরাজগঞ্জের মতো বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। ঘাসের গুরুত্ব বুঝতে বুঝতে লাভ না হওয়ার কারনে খামার বন্ধেরও অনেক গল্প প্রতি বছর শোনা যায়। তাই উন্নত প্রজাতির ঘাসের সহজলভ্যতা সিলেটে ডেইরী শিল্পের বিপ্লব ঘটাতে পারে ।
পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচা ঘাস দিলে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন পর্যাপ্ত পরিমাণ পায়, যা গাভীকে কম খরচে সর্বোচ্চ দুধ গাভী দিয়ে থাকে। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার বা ঘাস দেওয়া উচিত নয়। ড্রাই মেটারের উপর হিসাব করে সরবরাহ করা উচিত। অতিরিক্ত খাদ্য সরবরাহ গাভীর দুধ উৎপাদনকে ১০% করে হ্রাস করে। গাভীর প্রজনন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কাঁচা ঘাস থেকে সিনথেসিস হয়।
গাভীর জন্য কাঁচা ঘাসের কোন বিকল্প নেই। গরু তৃণভোজি প্রাণী। তাই গরুর প্রধান খাদ্য হচ্ছে তৃণ মানে ঘাস। পূর্বে কৃষকরা দেশী গরু পালন করলেও বর্তমানে সেখানে স্থান গ্রহণ করেছে উন্নত প্রজাতির সংকর গাভী। কিন্তু উন্নত প্রজাতির সংকর গাভীর জন্য যে উন্নত প্রজাতির ঘাস দরকার সেটি চাষ করে গাভীকে খাওয়ানোর ব্যাপারে কৃষকরা এখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। তারা চাষ করলেও খুবই অল্প পরিমাণে চাষ করে থাকেন, যা তার চাহিদার তুলনায় নগণ্য। একটি পূর্ণ বয়স্ক বিদেশী গাভীর জন্য বার মাস কাঁচা ঘাস সরবরাহের জন্য দশ শতাংশ জমিতে কাঁচা ঘাস থাকা প্রয়োজন। আবার উন্নত প্রজাতির কাঁচা ঘাসের পুষ্টিমান স্থানীয় ঘাসের তুলনায় অনেক বেশি। যার কারণে গাভীর স্থানীয় ঘাস খাওয়ানোর পরেও অপুষ্টি জনিত সমস্যা দেখা দেওয়ার পাশাপাশি গাভীর দুধ উৎপাদন খরচ অনেক বৃদ্ধি পায়। ফার্ম করতে গেলে কাঁচা ঘাসের কোন বিকল্প নেই। তাই একটি আদর্শ খামারে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচা ঘাস থাকা প্রয়োজন। গর্ভ অবস্থায় গাভী পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচা ঘাস না পেলে বাছুর জন্মান্ধ হতে পারে।
সিরাজগঞ্জ অধিকাংশ খামারে উন্নত প্রজাতির ঘাসের ব্যবস্থা আছে। যার উৎপাদন খরচ প্রতি কেজিতে ১ টাকা, বাথানও বিদ্যমান। রংপুরে ঘাস উৎপাদন ব্যাপক আকারে হয়ে থাকে। ঘাসের বাজারও বিদ্যমান। বিদেশে বড় বড় জায়গায় ঘাস চাষ করে। পরবর্তীতে সাইলাইজ করে সংরক্ষণ করে গরুকে খাওয়ানো হয়। ভারতের খামারিরা পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচা ঘাস চাষ করে থাকে। সিলেটের অধিকাংশ খামারে ঘাস নেই। পরিবর্তে আছে কচুরিপানা, হাওড়ের লোকাল ঘাস, বন-জঙ্গলের লতাপাতা। তবে বর্তমানে ঘাস চাষের দিকে অনেক খামারি নজর দিচ্ছে ।
বিভাগীয় কমিশনার বলেন, "সিলেট অঞ্চলে প্রচুর অনাবাদি জমি রয়েছে।" কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ জনাব কৃষ্ণ চন্দ্র হোড় বলেন, "সিলেট বিভাগে মোট ৭ লাখ ৮৯ হাজার ১০৩ হেক্টর ফসলি জমি রয়েছে। এসব জমির মধ্যে রবি মৌসুমে পতিত থাকে ১ লাখ ৬৪ হাজার হেক্টর( ৪০৫২৫২৪৩ শতক) বা ১২ লক্ষ ২৮ হাজার কিয়ার জমি খরিপ-১ মৌসুমে জমি পতিত থাকে ১ লাখ ৮১ হাজার ৭২৫ হেক্টর(৪৪৯০৫১৮১ শতক) বা ১৩ লক্ষ ৬০ হাজার কিয়ার, খরিপ-২ মৌসুমে ৭১ হাজার ৫০১ হেক্টর(১২৭২৬১ শতক) ৩৮৪৬ কিয়ার জমি পতিত থাকে।"
তাহলে আমরা এই পতিত জমিতে যদি উন্নত প্রজাতির ঘাস (ভুট্তা, নেপিয়ার, জার্মান, জাম্বো ইত্যাদি) চাষের আউতায় আনতে পারি তাহলে প্রতি গরুর জন্য ১০ শতক ধরে আমরা রবি মৌসুমে প্রায় ৪০ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টি গরুর পর্যাপ্ত ঘাসের ব্যবস্থা করা যাবে (৪০৫২৫২৪৩ শতক) খরিপ-১ মৌসুমে প্রায় ৪৪ লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টি গরুর পর্যাপ্ত ঘাসের ব্যবস্থা করা যাবে (৪৪৯০৫১৮১ শতক), খরিপ-২ মৌসুমে প্রায় ১২ হাজার ৭০০ টি গরুর পর্যাপ্ত ঘাসের ব্যবস্থা করা যাবে, যেহেতু (১২৭২৬১ শতক) জমি পতিত থাকে। অথচ আমরা শীতকাল বা রবি মৌসুমেই গোখাদ্যের সংকটে পড়ে থাকি।
এ অঞ্চলের মাটির কথা কি আর বলব, এ অঞ্চলের মাটিরও রয়েছে বৈচিত্রতা। টিলা, পাহাড় এবং সুরমা অববাহিকা হওয়ায় বেশিরভাগ মাটিই অম্লীয় মাটি। অনেকাংশে অম্লীয় মাত্রা পিএইচ স্কেলে ৪.০০ এর নিচে। পিএইচ স্কেলে মানদন্ড হয় ০ থেকে ১৪ পর্যন্ত। মান ৭ উপরে হয় মাটি হবে ক্ষার জাতীয় অর্থাৎ মাটিতে লবণের পরিমাণ বেশি এবং ৭ থেকে নিচে হলে সেই মাটি অম্ল অর্থাৎ মাটিতে এসিডের পরিমাণ বেশি। মাটির পিএইচ মান ৭ হলো স্বাভাবিক। পিএইচ মান এর কম হলে ওই মাটি অনেক প্রয়োজনীয় কিছু উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম (Ca), ম্যাগনেসিয়াম (Mg) হারায়। ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়। এমতাবস্থায় জমিতে ক্ষারক ব্যবহার করে অ্যাসিডটিকে প্রশমিত করে উর্বরতা শক্তি ফিরিয়ে আনা হয়। চুন (CaO) হলো এক প্রকার ক্ষারক যা মাটির অম্লের সঙ্গে বিক্রিয়া করে অম্লকে প্রশমিত করতে সক্ষম। ফলে পিএইচ মান কৃষি উপযোগী হয়ে ওঠে।
পিএইচ নির্ণয় করা বেশ সহজ একটি কাজ। আর এ কাজের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হচ্ছে পিএইচ মিটার ব্যবহার করা। এছাড়া ইন্ডিকেটর বা নির্দেশক ব্যবহারের মাধ্যমেও পিএইচ মান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব। বাজারে মাটি পরীক্ষার জন্য পিএইচ মিটার পাওয়া যায়, আপনারা চাইলেও সংগ্রহ করতে পারেন কিংবা এই লিংক থেকে (http://bit.ly/2qU7iNd) ভিডিও দেখে ধারণা নিতে পারেন। নতুবা স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার অথবা উপজেলা কৃষি অফিস যোগাযোগ করে জমির পিএইচ পরীক্ষা করে নিন । তবে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে মৃত্তিকা ভবন থেকে মাটি পরীক্ষা করিয়ে নিলে সর্ব্বোত্তম । এই লিংকে (http://bit.ly/2PRJzWj) দেওয়া আছে কিভাবে মাটি পরীক্ষার জন্য মাটির নমুনা সংগ্রহ করতে হয়।
জমি পতিত থাকার উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো
এসব পতিত জমি আমরা যদি উন্নত প্রজাতির ঘাস চাষের আওতায় আনার আনা যায় তাহলে কম খরচে দুগ্ধ উৎপাদনে সিলেটে বিপ্লব করা সম্ভব। প্রযুক্তির সাথে থাকুন, সফলতাকে ধরে রাখুন।
লেখক
ডাঃ বর্মেন্দ্র সিনহা
ডিভিএম, এমএস থেরিওজেনলজি
টেরিটরি এক্সিকিউটিভ (ক্যাটল ফিড), সিলেট জোন
এসিআই গুদরেজ এগ্রোভেট প্রাইভেট লিমিটেড