
বিজয়ের ৪৮ তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে৷ আমরা স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখেনি কিন্তু দেখেছি দেশ বিনির্মাণের আরেক সংগ্রাম ৷ মুক্তিযোদ্ধারা এবং দেশের মেহনতি মানুষ যে সোনার সমৃদ্ধ বাংলার জন্য রক্ত দিয়েছিল, যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তারা লড়েছিল, তার অনেকটুকুই বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে ৷ আজ সকল প্যারামিটারে বাংলাদেশ পাকিস্তান কে ছাড়িয়ে গেছে ৷ বাংলার ভিত্ত্বি ছিল কৃষি ৷ আজ ৪৮ বছরে সেই কৃষির প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝের দুরত্ব কতটুকু দূর হয়েছে তা বিশ্লেষণ এখন সময়ের দাবি৷
স্বাধীনতার যুদ্ধের পর সাত কোটি বাঙালী নিয়ে ধ্বংসস্তুপ থেকে যে যাত্রার শুরু, দু'বছরের মাথায় দেখতে হয় এক দুর্ভিক্ষ৷ কোথায় আছে সে দেশ বর্তমানে কৃষিতে? হেনরি কিসিঞ্জার যাকে উপহাস করে বলেছিল "তলা বিহীন ঝুড়ি" সেই দেশটি আজ বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ, ফসলের জাত উদ্ভাবনে শীর্ষে৷ সবাই কে অবাক করে বিশ্বে সবজি উৎপাদনে জনবহুল বাংলাদেশ এখন তৃতীয় অবস্থানে। লবণাক্ত, খরা, জলমগ্নতা সহনশীল ও জিংকসমৃদ্ধ ধানসহ ১০৮টি উচ্চফলনশীল জাত ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। কেবল সবজি আর ধানেই নয় মাছ ও ছাগল উৎপাদনেও বিশ্বে আয়তনের দিক থেকে অনেক পেছনে থাকা বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ, আমে সপ্তম ,আলুতে অষ্টম এবং ফলে দশম। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, বিশ্বে যে পরিমান ইলিশ উৎপাদন হয় এর মধ্যে আমাদের দেশেই উৎপাদন হচ্ছে ৮৬ শতাংশ।
বাংলাদেশে দুধ উৎপাদন মাথাপিছু ১৬৫ মিলিলিটার৷ গত এক দশকে দুধ উৎপাদন বেড়েছে ৩.২ গুন৷ মাংসের চাহিদা ১২০ গ্রামের তুলনায় উৎপাদিত হচ্ছে ১২৫ গ্রাম করে৷ গত কোরবানী ঈদে ১০ লাখ গবাদিপশু অতিরিক্ত ছিল৷ মানুষের বছরে ১০৪টি ডিম দরকার, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ১০৩টি৷ আশা করা যাচ্ছে ২০২০ সালে সেটিও পূরন হয়ে যাবে৷ মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মাছ রফতানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সফলতা অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ।
যেখানে দিনদিন আবাদ জমি হ্রাস পাচ্ছে সেখানে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া বাংলাদেশের জন্য সত্যি অভাবনীয়৷ এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে দেশের কৃষিবিজ্ঞানি ও কৃষিবিদের মেধা আর কৃষকের অমূল্য শ্রম ও ত্যাগের মাধ্যমে৷ সরকারি কিছু পদক্ষেপ এই সব সফলতার পিছনে মূল প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছে৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিজয়ের ৪৮ বছর পুর্তির উপহার হিসেবে ১৬ ডিসেম্বর থেকে ডিএপি সারের দাম ভর্তুকি দিয়ে ৯ টাকা কমিয়ে দিয়েছেন৷ এছাড়াও বিদ্যুৎ এর দামে ভর্তুকি,দশ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খোলা, বিভিন্ন জায়গায় বন্যা নিয়ন্ত্রন বাধ নির্মান, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান ইত্যাদি নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এছাড়াও দেশের ৩৫টি জেলায় ২৫ শতাংশ ভর্তুকিতে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, হারভেস্টরসহ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে৷ ফলে গতি এসেছে কৃষিতে৷
জিডিপিতে বর্তমানে কৃষির অবদান ১৩.৬৷ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে দেশের আমদানি ব্যয় বহুলাংশে কমে গেছে৷ বরং বেড়েছে কৃষিপণ্য রপ্তানি৷ চট্রগ্রাম কাস্টমস এর তথ্য মতে বিদেশি ফল আমদানি কমায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৯৯ কোটি টাকা৷ কৃষি পণ্য রপ্তানিতে ২০১৭-১৮ তে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯৭ %৷ রপ্তানী আয় ছিল প্রায় ২৯ কোটি ডলার৷ ২০১৮ -১৯ এ তা বেড়ে দাড়ায় ৯০ কোটি ডলারে৷ লক্ষ্যের চেয়ে আয় বাড়ে ২৯ শতাংশ৷ যা সত্যিই অভাবনীয়৷
এতো গেলে প্রাপ্তির হিসাব, কিন্তু কিছু অপ্রাপ্তির হিসাবও রয়ে গেছে৷ স্বাধীনতার আগে কৃষক-শ্রমিকের আশা ছিল ন্যায্য দাম,ন্যায্য মজুরি যা আজও নিশ্চিত করা যায় নি৷ আজও দাম না পেয়ে কৃষক ধান ক্ষেতে আগুন দেয়, দুধ রাস্তায় ফেলে প্রতিবাদ করে৷ দেশে গড়ে উঠেনি সুশৃঙ্খল কৃষি বিপনন ব্যবস্থা৷ কৃষকরা ধান উৎপাদনে মণ প্রতি প্রায় দুশত টাকা লোকশান গুণছেন৷ ফলে ধীরে ধীরে কৃষকরা চাষের প্রতি নিরুৎসাহিত হয়ে পরছেন৷ এভাবে সবাই নিরুৎসাহিত হলে দেশ যেকোন সময় খাদ্য ঘাটতিতে পরতে পারে৷ এছাড়া কৃষিপণ্যের নেই ভাল সংরক্ষনের ব্যবস্থা৷
দেখা যায়, কোল্ড স্টোরেজের অভাবে বহু আলু গত অর্থবছরে নষ্ট হয়েছে৷ উৎপাদিত দুধের মাত্র ৭ শতাংশ বেসরকারি প্লান্টে যায় বাকি অধিকাংশে দুধ সঠিক সংরক্ষনের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়৷ যদিও সরকার কৃষি যান্ত্রিককরনের দিকে নজর দিচ্ছে তবুও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম৷ ধান চাষীরা কৃষিতে ভর্তুকি পেলেও মাছ ও গবাদিপশু পালনে কৃষকরা বিদ্যুতে ভর্তুকি পান না৷ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করণে কমিউনিটি ক্লিনিক করলেও সকল ইউনিয়ন পর্যায়ে পশু চিকিৎসক, কৃষি অফিসার, মৎস অফিসারের দপ্তর করা হয় নি৷ ফলে সঠিক সময়ে সঠিক সেবা থেকে প্রান্তিক চাষীরা বঞ্চিত হচ্ছে ৷ কৃষি গবেষনা খাতে সরকারের অনুদান থাকলেও তা খুবই অপ্রতুল৷ আধুনিক বিজ্ঞান ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলেই কেবল কৃষকদের ন্যায্য হিস্যা পৌছে দেয়া সম্ভব৷ আগামী ২০৩০ সালের মাঝে এসডিজি অর্জনে যে লক্ষ্য রয়েছে, তা পূরনের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে কৃষি৷ এছাড়া ভিশন ২০২১ ও রুপকল্প ২০৪১ পূরন করতে হলে কৃষিক্ষেত্রে আরো আধুনিকায়ন করতে হবে ৷
পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং কৃষি বিভাগের হিসাব মতে প্রতি বছর দেশের কৃষি জমির পরিমান কমছে ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর, অর্থাৎ প্রতি বছর শতকরা এক ভাগ হিসাবে আবাদ যোগ্য জমির পরিমান কমে যাছে। তাই আনুভূমিক কৃষি না বাড়িয়ে কিভাবে উলম্বিকভাবে কৃষিকে বিস্তার করা যায় দিকেও চিন্তা করতে হবে৷ সবচেয়়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সঠিক পরিকল্পনার দিকে৷ বাড়তি জনসংখ্যার চাপ সামলে চাহিদা ও উৎপাদনের ভারসাম্য রক্ষা করে পুরো দেশকে একটি পরিচ্ছন্ন কৃষিম্যাপিং এর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে৷ কৃষিবীমার আওতায় এনে কৃষকদেরকে ক্ষতির হাত থেকে সুরক্ষা দিতে হবে৷ কৃষিবিদ এবং কৃষিবিজ্ঞানীদের যথাযথ মর্যাদা ও মূল্যায়ন করতে হবে,গবেষনায় অধিক বরাদ্দ দিতে হবে৷ কৃষি প্রযুক্তিকে মাঠ পর্যাযে দ্রুত ছড়িয়ে দিয়ে প্রযুক্তি আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে৷ তবেই ন্যায় ন্যাযত্যা এবং সমৃদ্ধির জন্য বাংলার আপামর কৃষক জনতা যে লড়াই ১৯৭১ করেছিল, তার পূর্ণতা আসবে৷
লেখকঃ
ডাঃ সাজেদুল হক শৈবাল
ডিভিএম, এম এস ইন প্যাথলজি (বাকৃবি)
কাস্টমার সার্ভিস অফিসার
এসিআই এনিমেল হেলথ
মেইলঃ saibaldvm@gmail.com