www.agribarta.com:: কৃষকের চোখে বাংলাদেশ
শিরোনাম:

প্রানিসম্পদের অর্গানোগ্রাম এবং ভেট ও এএইচ অনুষদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ


 সম্পাদকীয়    ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, সোমবার, ১১:৫৪   সম্পাদকীয় বিভাগ


বাংলাদেশ ডিজিটালাইজড হয়েছে, বাঙ্গালী বড়লোক হওয়া শুরু করেছে। কিছুতো চোখে পড়ছে! শুধু চোখে পড়ছেনা বড়লোক হওয়াটা স্থায়ি হচ্ছে কিনা। চোখে পড়ছে শুধু ছুটে চলা মানুষের ভিড়। চলমান জীবনটা কতটুকু সিকোয়েনশিয়াল (ধাপ বাই ধাপ) সেটা চোখে পড়ছেনা। আমার ফ্যাকাল্টির শিক্ষার্থীদের দেখছি বিসিএস গাইড নিয়ে পড়ে থাকে। পাশ করবে কিনা এখনো ঠিক করেনি, কিন্তু বিসিএস পরীক্ষা দিবে ঠিক করে ফেলেছে। নিজের বিষয় কিছু শিখেছে কিনা ঠিক নেই, চাকরি পেলে কি করবে সেটা ঠিক শিখে ফেলছে। আমি একজন ভেটেরিনারিয়ান ও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রাণিসম্পদ নিয়ে কাজ করি। কিছুদিন আগে ডিএল এসের একটি অর্গানোগ্রাম ফেসবুকে পাশ হয়েছে । বাস্তবজীবনে এটার প্রয়োগ কবে থেকে এটা জানা নেই। শীঘ্র হোক সেটা দোয়া করি।

মনের দুখে অথবা মনের আনন্দে অনেকে ফেসবুকে পোষ্ট দিচ্ছে। অনেক বড় বড় পোষ্ট, আমি খুব মনযোগ দিয়ে পড়েছি। এই প্রাসঙ্গিতায় আমিও কিছু লিখেছি। যারা (মূর্খ/জ্ঞ্যানী) কর্ম করে জীবিকা চালায় তারা সবাই সেলসম্যান (Salesman)। কেউ শক্তি বিক্রি করে, কেউ বুদ্ধি বিক্রি করে, কেউ শস্য বিক্রি করে, কেউ জ্ঞ্যান ও দক্ষতা বিক্রি করে। আমরা যারা বিশেষ (ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,উকিল ইত্যাদি) পদে যেমন প্রাণিসম্পদে চাকরি করি তারা প্রানীস্বাস্থ্য ও উৎপাদন বিষয়ে জ্ঞ্যান ও দক্ষতা বিক্রি করি। বাকৃবির দুটি অনুষদ থেকে আমরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই জ্ঞ্যান বিতরন করি যাতে আমাদের প্রস্তুতকৃত বিশেষজ্ঞগন তাদের এই জ্ঞ্যান ভাল্ভাবে বিক্রি করে স্বাবলম্বি হয়ে SDGs পূরন করতে পারে। আমি ফেসবুকে দেখছি এই অর্গানোগ্রাম উপলক্ষ্যে আমাদের এই শিক্ষার্থীরা কিভাবে নিজেদের বিশেষত্ব প্রকাশ করছে ( স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ/ পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ/ডেইরি বিশেষজ্ঞ/পুষ্টি বিশেষজ্ঞ অথবা প্রজনন অথবা জাত বিশেষজ্ঞ/ গবেষক)। কিন্তু আপনারা কেউ লেখেননি অথবা চিন্তা করেছেন কি আপনাদের বায়ার যারা, স্টেকহোল্ডার যারা (যারা আপনার জ্ঞান কিনবে) তারা কোন বিশেষজ্ঞ চায়?

যারা হিউমেন মেডিসিন বা পাব্লিক হেলথ ডিল করে তারা শুধু First (I means ডাক্তার নিজে) এবং second persons (you means রোগী) ডিল করে। কিন্তু প্রানিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা (সব বিশষজ্ঞদের এক সাথে বললাম) First & second persons (বিশেষজ্ঞ নিজে & প্রাণি) এর সাথে ব্হু Third person plural numbers (খামারী, আইন প্রনেতা, কোম্পানী, টেকণিশিয়ান ও কর্মচারী, মজুর ইত্যাদি) নিয়ে ডিল করতে হয়। সমস্যাটা হলো আমারা যে তুমি নিয়ে ডিল করি তারা নিজের আলো বাতাস সমৃদ্ধ ঘর নিজেরা বানাতে পারেনা, নিজের খাবার নিজে প্রসেস করতে পারেনা। খামারিকে বলতে পারেনা যে বেশি দুধের জন্য হরমোন মিশ্রিত পুষ্টি খাওয়ালে কোটি টাকা খরচ করে ১০০ লিটার দুধ দেওয়া মায়ের ছেলের বীজ নিয়ে কৃত্রিম প্রজনন করালেও বাচ্চা হবেনা। খামারী এখন শুধু একটি মুরগি বা গাভীর ব্যবস্থাপনা করতে চায়না, খামারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করতে চায়। ইন্টারনেট দেখে অথবা বই নকল করে হয়তো কয়টা এন্টিবায়োটিকের নাম লেখা যায়, একটা ব্যথানাশক দেওয়া যায়, কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কি করা সম্ভব? আমরা বিশেষজ্ঞরা ভালবাসি মুরগি কে, খামারি ভালবাসে মাংসকে, বিশেষজ্ঞরা ভালবাসে গাভীকে কিন্তু খামারি ভালবাসে দুধকে। কারন মুরগির মাংস তাকে টাকা দেয় এবং আরো মুরগি দেয়। সেরকম দুধ টাকার মাধ্যমে গাভী দেয়। অনেক খামারি পুথিগত বিদ্যার অভাব থাকলেও দক্ষতার সাথে ফেসবুক বা ইন্টারনেট চালাতে পারে ।

আমি ২০০৭ সাল থেকে পি এইচ ডির গবেষনার সময় থেকে উন্নত দেশের এই সকল Web literate খামারির সাথে পরিচিত। গত চার বছর ধরে বাংলাদেশে মাঠ পর্যায়ে গবেষনা আছে বলে বাংলাদেশে এদের অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে জানি এবং মুখোমুখি হয়েছি। এখনকার খামারিরা শুধু মুরগী নয়, গাভী কখন ডিম পারে বলতে পারে। পৃথিবির বিখ্যাত বিখ্যাত প্রজনন ষাড়ের নম্বর জানে এবং তাদের মা ও মেয়ের গুনাগুন জানে। অনেক ব্রিডিং বিশেষজ্ঞ না জানলেও খামারি জানে রিপিট ব্রিডিং একটি রোগের নাম এবং রিপিট ব্রিডিং ও ম্যাস্টাইটিস ডেইরি শীল্পের অন্যতম প্রধান শত্রু। খামারি জানে তার খামারের জন্য সব (গবেষক ,স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ,পোল্ট্রি / ডেইরি বিশেষজ্ঞ,পুষ্টি বিশেষজ্ঞ অথবা প্রজনন অথবা জাত বিশেষজ্ঞ) বিশেষজ্ঞ লাগে। কিন্তু তার দুধের টাকা সে সবার সাথে ভাগ করতে চায়না। উন্নত দেশের খামারিরা তাই তার চাহিদা মিটানোর জন্য এবং টাকার ভাগ কমানোর জন্য খামারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করতে চায় বলে আইন প্রণেতাদের দিয়ে এই বিশেষজ্ঞদের ককটেল বানিয়ে ফেলেছে যাদেরকে তারা এখন বলে প্রাকটিশনার। বিজ্ঞান যেমন বর্তমান ব্যস্ত মানুষের জীবনে ব্যস্ততা টিকিয়ে রাখার জন্য নিয়ে এসেছে স্মার্ট বা এন্ড্রয়েড ফোন (ককটেল অব টেলিফোন, মোবাইল, টিভি, ক্যামেরা, কম্পিউটার, স্কানার, রিমোট, রেডিও, ভিডিও অ-নে—ক কিছু)। খামারি ও তেমন পোল্ট্রি প্রাকটিশনার মানে বুঝে মুরগির স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান, লালপালন,প্রজনন, জাত এবং গবেষনা বিশেষজ্ঞ; ডেইরি মানে দুগ্ধগাভীর স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান, লালপালন ও প্রজনন এবং গবেষনা বিশেষজ্ঞ। তাই উন্নত দেশে ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি কারিকুলাকে Need based একসাথে করা হয়েছে , গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে Day1 skill নিয়ে।

বাকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদের স্টুডেন্টরা রোগ ভাল জানে, পশু পালন অনুষদের স্টুডেন্টরা জাত ও পুষ্টি ভাল জানে। কিন্তু দুই অনুষদের স্টুডেন্টরা কেউ ভালভাবে জানেনা জাতের সাথে রোগের যোগসূত্র কোথায় এবং কিভাবে। দুজনের কেউ জানেনা অসময়ের পুষ্টি কিভাবে সুখের অসুখ বানিয়ে ফেলে। দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি আমাদের এই দুই অনুষদের ডিগ্রীর কারিকুলা অসম্পূর্ন, অনেক অপূর্ন্তায় ভরা। উন্নত দেশ গুলিতে উৎপাদন হচ্ছে Poultry/Dairy/ Small Animal Practitioners। ডিজিটালাইজেশনের যুগে বাংলাদেশের খামারিরাও এই তথ্য জেনে ফেলেছে, বুঝে ফেলেছে তার লাভজনক অর্থনীতির জন্য খরচ কমাতে হবে, খামারি লাভবান হবে মানে, দেশ সস্পদে স্বয়ংসম্পুর্ন হবে, দেশে উন্নত হবে, তাই স্টেকহোল্ডাররা, আইন প্রনেতারা এখন স্মার্ট বিশেষজ্ঞ উৎপাদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুস্থ জীবনের জন্য সূধীজনরাও এখন মানুষ ও প্রানি স্বাস্থ্য নিয়ে (One health) একসাথে চিন্তা করছে। সরকার ২০০ বা ২০০০ জনের জন্য নয় , বিশ কোটির জন্য SDGs পরিকল্পনা করেছে। বাকৃবি মায়ের এই দুই কন্যারা যদি এই স্মার্ট সত্যটি উপলব্ধি না করে তাহলে এই দুই বোনের সন্তানরা শুধুমাত্র বঞ্চিত হবে। আর কত!

আমাদের ঘরের দ্বন্ধে প্রতিবেশির সন্তানরা সামনে এগিয়ে চলছে, নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৮ বছর। আমাদের চিন্তা চেতনা পরনির্ভলশীলতা থেকে কবে মুক্ত হবে? আমার সন্তানতুল্য উত্তরসুরীদের উপর কেন আমাদের পুরাতন চিন্তা চাপিয়ে দিচ্ছি? আগে না হয় গ্লোবালাইজেশন এনালগ সিস্টেমে ছিল, কিছু চোখ পড়েনি। এখন তো গ্লোবালাইজেশন জিটালাইজড হয়েছে, এক আঙ্গুলে এক সেকেন্ডে ১০০ দেশের তথ্য জানা যায়। কেন আমরা আমাদের স্টূডেন্টদের এই সত্যটা থেকে দুরে রাখছি , কেন তাদের মুক্তভাবে স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে দিচ্ছিনা? সত্যি কথা বলতে কি এই অর্গানোগ্রামে আমাদের দুই ফ্যাকাল্টির গ্রাজুয়েটদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে অতিরিক্ত প্ররিশ্রমে তারা শুধু হাফিয়ে উঠবে, হতশায় নিমজ্জিত হবে। সময় এসেছে আমাদের এই দুই অনুষদের তরুনদের আবেগ ঝেড়ে ফেলে বাস্তবের মুখোমুখি হওয়া।

আমাদের পুর্বসুরীদের ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধে উঠে উত্তরসুরীদের সুখ বা দুঃখ কোনটাই চোখে পড়েনি। দেশের স্বার্থে এখন বিএস সি ইন ভেট সাইন্স এন্ড এএইচ ডিগ্রীর গ্রাজুয়েট দরকার। আমার উত্তরসুরীদের সুখটাই চোখ পড়ছে যদি সে সময়ের সাথে নিজেকে তুলে ধরতে পারে। ইতিহাস সাক্ষী- সময়ের স্রোত প্রয়োজনহীন কে অতলে তলীয়ে ফেলে।, কিন্তু প্রকৃতি কোন শুন্যস্থান রাখেনা, তাই বিজ্ঞান কোন কিছু ডিলিট করেনা নতুন পুরাতন কে মার্জ (Merge) করে যার উপর নতুনের ভিৎ স্থাপন করে। আর তরুনরাই সময়ের প্রয়োজনে নতুনকে বরণ করে। সময় এসেছে এই দুই অনুষদের তরুনদের (গ্রাজুয়েট এবং টু বি গ্রাজুয়েট) সিদ্ধান্ত নেওয়ার তারা কি এনালগ যুগের সিনিয়রদের মত আন্দোলন করতে করতে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হবে, না কি ডিজিটাল স্মার্ট যুগের বাংলাদেশে স্মার্ট সম্পদে পরিনত হয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করবে। অপেক্ষায় থাকলাম কবে বোধোদয় হয় দেখার জন্য............।

ড. নাছরীন সুলতানা জুয়েনা
প্রফেসর
সার্জারি ও অবস্টেট্রিকস বিভাগ
বাকৃবি, ময়মনসিংহ
juyenahabib@yahoo.com




  এ বিভাগের অন্যান্য