
কোন একটি দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য কেমন আছে তা জানার জন্য সেদেশের গবাদিপশুর স্বাস্থ্য কেমন তা জানাই যথেষ্ঠ। আমরা এতটুকও বাড়িয়ে বলছি না, এটা বিজ্ঞান ভিত্তিক এবং প্রমানিত, তবে আমরা আজ এই বিষয়ে আর এগুচ্ছি না। আজ আমরা লিখতে চাচ্ছি এই গবাদিপশুর স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কথা অর্থাৎ ভেটেরিনারিয়ানদের কথা।
১৯৬২ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায় (বাকৃবি) প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৯৪ সাল পযর্ন্ত বাংলাদেশে শুধুমাত্র বাকৃবি থেকেই ডিভিএম ডিগ্রি দেয়া হত, প্রতি বছর ছাত্র-ছাত্রী বের হত ৬০-৭০ জন। খুব সংগত কারনেই সে সময়ের একজন ডিভিএম গ্রাজুয়েটের মর্যাদা ও চাহিদা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশ সম্মানজনক। এর পর ডিভিএম ও এএইচ এর চির বিরোধ নিরসনকল্পে ডিএলএস এর প্রকল্প থেকে একসাথে চারটি কলেজ চালু করা হল যদিও সে লক্ষ্য পুরণ হয়নি কিন্তু কলেজ তৈরির প্রকল্প বন্ধ হয়নি। বাকৃবির সিট সংখ্যা বছরে বছরে বৃদ্ধি করা হল। বাৎসরিক ৬০-৭০ জন ছাত্র বর্তমানে বেড়ে দাড়ালো ৩০০ তে। বিপরীতে চাকুরীর একটা সম্মান জনক জায়গা বলতে গেলে শুধু বিসিএস যেখানে বাৎসরিক গড় নিয়োগ ৫০-৬০ এর বেশি নয়। আর ভেটেরিনায়িানদের বেসরকারি চাকুরী? সেখানে তাদের জন্য নেই কোন আলাদা পলিসি, কর্ম পরিবেশ। যারা সেখানে জব করেন তারা তা হাড়ে হাড়ে বুঝেন আর চাকুরীর নিশ্চয়তার কথা না হয় বাদই দিলাম, সেটা আশা করাও অনেক ক্ষেত্রে দুরাশার শামিল।
প্রথমেই আসা যাক যেটাকে ভেটেরিনায়ানগণ আরাধ্য ভাবেন সেই বিসিএস চাকুরীর কী অবস্থা? ২৭ টি ক্যাডার সার্ভিসকে র্যাংকিং করলে তলানির দিক দিয়ে প্রথম হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এই যখন অবস্থা তাহলে দেশের মেধাবী ছাত্রদেরকে (যেখানে মোট বরাদ্ধ সিটের মাত্র ১০ গুন পরীক্ষা দিতে পারে) এই রকম একটি মানবিক পরিস্থিতিতেফেলার কারণ কি? দেশে বর্তমানে ভেটেরিনারি ডিগ্রি দেয় এমন প্রতিষ্ঠানের মোট সংখা কতটি? আমি জানি এই প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছে তৈরি নেই বা খুব কমজনই আমরা তার খোঁজ রাখার সুযোগ পাই, এটা দোষের কিছু না। আমি বলছি, এরুপ প্রতিষ্ঠান আমার জানামতে ১৩ টি, যারা প্রতিবছর দেশে ১০০০+ ভেটেরিনারি ডাক্তার তৈরি করছে (এই সংখা আরো বাড়তে পারে বই কমবে না) । তাহলে এই বিশাল টেকনিক্যাল গ্রাজুয়েটদের ভবিষ্যৎ কী?
আমার জানা মতে, এবার অনেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় টিকেছেন, হয়তোবা অনেকের চাকুরির শেষ গন্তব্য হবে এটাই, অনেক ডিভিএম গ্রাজুয়েট ব্যাংকে চাকুরি করছেন। অন্যান্য অপ্রচলিত অনেক চাকুরিই এখন ভেটদের গন্তব্যে পরিনত হচ্ছে, ট্রেন্ড যেদিকে এগুচ্ছে ভবিষ্যতে এই সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না। তাহলে আমরা পাবলিকের ট্যাক্সের এত টাকা শ্রাদ্ধ করে, ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের মেধার অপচয় করে অপরিকল্পিতভাবে এত ভেটেরিনারি গ্রাজুয়েট তৈরি করছি কেন? এই প্রশ্নটা সংশ্লিষ্টদের প্রতি রাখাটা এখন খুবই যোক্তিক মনে হয়?
আমরা এই ঘটনাটির সাথে একটি বিশেষ পরিস্থিতির সামঞ্জস্য খুজে পাই। আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টি শিক্ষিত সমাজে খুবই জনপ্রিয় এবং সেখানে গ্রোথ হার ২:২ এর কম অপরদিকে স্বল্পশিক্ষিত দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে এখনো জন্মহার যথেষ্ঠ বিশেষ করে আশি-নব্বই এর দশকে এই জনগোষ্ঠির মধ্যে জন্মহার অনেক বেশি ছিল, যার ফলে দেশের একশ্রেনীর মানুষ অল্প সময়ে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছেন। ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না হয়তো, একটু পরিস্কার করা যাক। যেটা বলছিলাম আশি-নব্বই এর দশকে স্বল্পশিক্ষিত দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে যে সন্তানেরা জন্মগ্রহন করলো, তারা কর্মক্ষেত্রে ভির জমালো অনেকটা স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত থেকেই, বিশ্বের শ্রমবাজারের প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে সস্তাশ্রমিক পাওয়া গেল, দেশে ডেভেলপ করলো গার্মেন্টস শিল্প (আদতে দর্জিগিরি করা)। এই সস্তা শ্রম ব্যবহার করে কোটিপতি বনে গেল অসাধু একটি লুটেরা গোষ্টি। ঠিক একই ভাবে চাহিদার তুলনায় (যথাযথ কাজে লাগানোর প্রেক্ষিতে) অধিক পরিমান ভেটেরিনারিয়ান তৈরি করে, এই পেশার পেশাদারিত্বটাকেই নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। একটি সম্মানিত পেশার, একদল মেধাবী তরুনদের এই আত্মগ্লানিকর জীবন, অনিশ্চিৎ ভবিষ্যৎ সত্যিই দূর্ভাগ্যজনক।
এবার শেষ কথায় আসি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শিক্ষা বিষয়ে আলাদা উইং আছে। মেডিকেল কলেজগুলো তাদের অধীনে, তাই তারা চাইলে প্রজেক্ট নিয়ে মেডিকেল কলেজ করতে পারে কিন্তু ডিএলএস এর তো শিক্ষা নিয়ে কোন উইং নাই, তবে তারা কেন একের পর এক কলেজ বানিয়ে যাচ্ছে এবং কিছুদিন পরে যা অবধারিতভাবেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। ডিএলএস এর কি বেসিক কাজের অভাব আছে? তাদেরকে কেন কলেজ বিল্ডিং বানাতে হবে?
দুঃখজনক হলেও সত্যি এই মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে এবং সরব হতে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। যদি এটা প্রয়োজনীয় বা উপকারী হতো তাহলেও না হয় মেনে নেয়া যেত। একদিকে ভেটেরিনায়িান বাড়ছে কিন্তু তারা কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না তাদের কাজ করছে অন্যরা, অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত কোয়াকগণ। ফলশ্রুতিতে প্রাণিসম্পদ খাতের যথাযথ উন্নয়ন ব্যহত হচ্ছে, ব্যহত হচ্ছে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, হতাশাগ্রস্থ হচ্ছে ভেটেরিনারি পেশার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠা একা ঝাক মেধাবী তরুণ। ভেট প্রফেশনের সুধীজনদের এই মৌলিক বিষয়টি নিয়ে বিস্তর কাজ করার সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি।
ডা. মোঃ ওসমান গনি
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
ভেটেরিনারি পাবলিক হেল্থ এন্ড মাইক্রোবায়োলজি শাখা
লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এলআরআই), মহাখালী
ইমেইল: mosmandls@gmail.com
বিঃদ্রঃ লেখাটি মূলত Voice of Bangladesh Veterinarians (VBV) গ্রুপের ডিসেম্বর মাসের সম্পাদকীয়। মূল লেখাটি পাবেন এই লিংকে।