নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ নিশ্চিতকরণ ও মহামারি প্রতিরোধে

ভেটদের অনেকে মনে করেন গরুর ডাক্তার! দূর ওদের আবার কি গুরুত্ব? মনে রাখেন মানুষকে ভাল রাখতে হলে প্রাণীকেও ভালো রাখতে হবে। কারণ পৃথিবীর ৬০% রোগ আসে প্রাণী হতে, ৮০% এন্টিবায়োটিক ব্যবহার হয় এনিমেল ও পোল্ট্রিতে! যে দেশে এনিমেলে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার যত কম, সেদেশে মানুষে এন্টিবায়োটিক লাগে তত কম, রেজিস্টেন্সও তত কম। তার মানে দেশকে সুস্থ রাখতে ৬০% বিনিয়োগ প্রয়োজন ভেট হেলথে ও ৪০% প্রয়োজন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য। ভেট হেলথের জন্য যা বিনিয়োগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার সবটুকু উপকার মানুষেই পাবে। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য যা বিনিয়োগ তার কত ভাগ ভেট বিভাগের জন্য?
জেলাতে ডাক্তার আছে ১০০+, ভেট থাকার কথা প্রতি উপজেলায় একজন! তাও ২৫০ এর বেশি উপজেলায় ভেটেরিনারি সার্জনের পদ খালি! অবকাঠামোগত বিনিয়োগকে অনুপাতিক হারে হিসেব করলে মেডিকেল সেক্টরের তুলনায় ভেট সেক্টর হয়তোবা এক হাজার ভাগের একভাগ হবে কিনা সন্দেহ! একজন ভেট কিভাবে ডেইরি সেক্টর দেখবে! কিভাবে পোল্ট্রি দেখবে? ক্লিনিকেল সার্ভিসের দায়িত্বও তার, সম্প্রসারণ সার্ভিসের দায়িত্বও তার, রেগুলেটরি সার্ভিসের দায়িত্বও তার, পরীক্ষার দায়িত্বও করতে হবে- মিটিং করতে হবে মাসে ৮-১০ দিন। ৯ টা হতে ৫ টা অফিস টাইমে অফিসে চিকিৎসা সেবা আর খোলা আকাশের নিচে অপারেশনের উদ্ভট পদ্ধতিতে চলছে দেশের ক্লিনিকাল ভেটেরিনারি সার্ভিস।
একজন ডাক্তার দিয়েই একটি হাসপাতাল চলবে, একটি উপজেলা চলবে, এই বিধান রেখে প্রায় ২৫ বারের বেশি সংশোধনের পর পাশ হতে যাচ্ছে অরগানোগ্রাম। সেখানেও ধরা হয়নি এপিডেমিওলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট কিংবা এক্সটেনশন অফিসার পদ! তাহলে কোন মহামারি শুরু হবার আগের এপিডেমিওলজিক্যাল ডাটা কোথায় পাওয়া যাবে কিংবা আউটব্রেক হলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন কতটুকু সম্ভব হবে?

মানুষের স্বাস্থ্য সেবার আধুনিক হতে অত্যাধুনিক অবকাঠামো স্থাপন হচ্ছে অথচ কোন উপজেলায় ভেটেরিনারি ক্লিনিকাল সুবিধা নেই, হাসপাতাল নেই- ২৪ ঘন্টা চিকিৎসা সেবা নেই। তাও আবার শুক্র, শনি দুই দিন প্রাণিসম্পদ দপ্তর বন্ধ, যেনো রোগের সাথে চুক্তি করা আছে এই দুই দিন ও অফিস টাইমের পর কোন প্রানী অসুস্থ্য হবেনা। পৃথিবীর যতো মহামারী বিশাল জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর কারণ হয়েছে প্রতিটির উৎপত্তি ছিলো প্রাণী!
কলেরা > প্লেগ > ম্যাড কাউ > সার্স > সোয়াইন ফ্লো > বার্ডফ্লু > চিকুনগুনিয়া > ডেঙ্গু > করোনা... সবগুলোর উৎপত্তি কিন্তু প্রাণী। একটু কল্পনা করুন - আমাদের দেশে যদি বার্ডফ্লু ছড়িয়ে পড়ে বা চীন হতে করোনা ভাইরাস কোনভাবে চলেই আসে চায়না পণ্যের মত! কি অবস্থা দাঁড়াবে? আমাদের দেশে প্রচলিত ভেটেরিনারি সার্ভিসের দ্বারা কি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব? এক কথায় উত্তর স্টেট ভেটেরিনারি রেগুলেটরি সার্ভিস বলতে এদেশে আদৌ কিছু নেই।
দেশের আইসিইউতে ৮০% মৃত্যুর কারণ এন্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্ট সুপারবাগ, অন্যদিকে দেশ ভেসে যাচ্ছে প্রেসক্রিপশন বিহীন এন্টিবায়োটিক, কোয়াক, ডিপ্লোমাদের চিকিৎসার বন্যায়! আমরা কিভাবে আশা করি নিরাপদ প্রানিজ আমিষের! নিরাপদ ও সুস্থ জাতির। যেখানে ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়াতে শক্তিশালী কোয়ারেন্টাইন রুলস মেইন্টেইন করা হয় দেশকে সংক্রামক রোগ হতে মুক্ত রাখার জন্য- ভারত আমাদের গরু না দিয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা গোমাংস রপ্তানিকারক হওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেখানে আমরা কোরবানির হাটে ভারত মায়ানমার হতে চোরাই গরু এনে দেশীয় খামারিদের পথে বসাই।
কোন কোয়ারেন্টাইন বিধি না মেনে গরুর সাথে নিয়ে আসি হাজারটা রোগ। লাম্পি স্কিন ডিজিজ যার সর্বশেষ সংযোজন, যা দেশের ডেইরি খাতকে শক্ত ঝাঁকুনি দিয়ে গেলো। গরু চুরি করতে গিয়ে যারা বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারায় তাদের শহীদ বলি, বিএসএফের গুষ্টি উদ্ধার করি! আমাদের বিজিবি নীরব দর্শক, এই হলো আমাদের দেশপ্রেম। বার্ডফ্লু নিয়ে চলছে ধামাচাপার খেলা কিন্তু বার্ডফ্লু কবে যে মহামারি আকারে মানুষে ছড়াবে সেই আতংক তাড়া করে বেড়াচ্ছে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিদের প্রতিনিয়ত! একদিকে পোল্ট্রি খামারিরা গরীব হতে নিঃস্ব হচ্ছে, অন্য দিকে ইন্ডাস্ট্রি চলে যাচ্ছে বিদেশি কোম্পানিদের হাতে। অথচ জাতির বিবেক ঘুমিয়ে আছেই।
দেশীয় দুগ্ধ খামারিরা মূল্য পাননা অন্যদিকে দুধের অস্তিত্ববিহীন কনডেন্সড মিল্ক ও পাউডার দুধের নামে বিষ খাচ্ছি ও সুস্থ, সবল, মেধাবি জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখছি। দেশীয় পণ্যের বাজার নষ্ট করতে ভাড়াটিয়া গবেষকদের নির্লজ্জ বিধিবহির্ভূত রিপোর্টিং খামারীদের বারোটা বাজাচ্ছে। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয় যেদিন ৫০ টাকার পিয়াজ ২০০+টাকার মতো ১৫০ টাকার ব্রয়লার খেতে হবে ৫০০+ টাকায়। কিন্তু এখন খামারিরা সেটা ১০০ টাকায় বিক্রি করতে পারছেনা।
আমরা জাতি হিসেবে যতক্ষণ কোন সমস্যা দেখা না দেয় ততক্ষণ সজাগ হইনা, অভূতপূর্ব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেইনা। প্রাণিসম্পদ বিভাগকে শত বছর পিছিয়ে রেখে নিরাপদ খাদ্য ও সুস্থ জাতি আশা করা অবান্তর। কবে জাগবে জাতি, প্রশাসন, নীতিনির্ধারক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক নেতৃত্ব? যতক্ষণ না রানা প্লাজা বা পুরান ঢাকার আগুন লাগার মতো অভিশাপের মোকাবেলা করতে না হয়?
অতএব অতি দ্রুত ভেটেরিনারি সার্ভিসকে ইমার্জেনসি ঘোষনা করা হোক। ন্যাশনাল ভেটেরিনারি সার্ভিস প্রতিষ্টা করে শক্তিশালী ভেটেরিনারি রেগুলেটরি সার্ভিস নিশ্চিত করে মানব স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা হোক। সময়ের প্রয়োজনে প্রাণিসম্পদ বিভাগ যেমন শক্তিমান নয় তেমনি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয়ও যথেষ্ট শক্তিশালি নয়। কালে ভদ্রে আমরা পূর্ণ মন্ত্রী পাই।
অন্যদিকে একটি মন্ত্রনালয়ের প্রাণ হলো সচিব মহোদয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এই দুই ক্যাডার বিশিষ্ট একটি মন্ত্রণালয়ের একজন সচিবকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কর্মপদ্ধতির দুইটি অধিদপ্তরের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে পরিমান মেধা ও শ্রম দিতে হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ও সময়োপযোগী হতো যদি মৎস্য ও প্রানিসম্পদ মন্ত্রনালয়কে দুটি আলাদা মন্ত্রণালয় করা হয়। তখন দুইজন সচিব মহোদয়ের মেধা, সময় ও শ্রম পেতো দুটি বিভাগ, উভয় বিভাগই নিশ্চিতভাবে উপকৃত হতো, সর্বোপরি জাতি উপকৃত হতো।
মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ, ডিম, দুধে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পর, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে প্রাণিসম্পদ খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আলাদা মন্ত্রনালয় গঠন পূর্বক এ খাতকে শক্তিশালী করা ছাড়া কোন পথ খোলা নেই। অতএব প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয় আলাদা করে শক্তিশালী করা হোক, ভেটেরিনারি সার্ভিসকে ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা হোক,বর্ডার সিল করা হোক এখনি- না হলে আসুন আমরা অপেক্ষা করি কোটি প্রাণ ঘাতি এক মহামারির।
ডাঃ মোঃ নূরে আলম
ভেটেরিনারি সার্জন,
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, ঢাকা।
আএলএসটি, নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
nurealamdr@gmail.com