সাতক্ষীরায় দুধের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে লোকসানে খামারি

প্রাণি সম্পদ/
এগ্রিবার্তা ডেস্ক

(১ বছর আগে) ২২ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ৪:১৭ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৪:২৩ অপরাহ্ন

agribarta

সাতক্ষীরায় উৎপাদিত তরল দুধে চাহিদা মিটছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের। প্রতিদিন প্রায় এক লাখ লিটার তরল দুধ উৎপাদন হচ্ছে উপকূলীয় এ জেলায়। এসব দুধ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে দুধের দাম নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট নন খামারিরা। গো-খাদ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে সে অনুপাতে দুধের দাম না বাড়ায় টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে এসব খামারির।

জেলায় অন্তত তিন হাজারের অধিক ছোট-বড় দুধের খামার গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে সরকারের নিবন্ধিত খামারের সংখ্যা রয়েছে ২ হাজার ৫০০। এ ডেইরি শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে অর্ধলক্ষাধিক মানুষের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী তরল দুধ উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সাতক্ষীরা জেলা। উৎপাদন বাড়াতে জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে খামারিদের নানা ধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে জেলার অধিকাংশ খামারিদের অভিযোগ, সরকারি কোনো সহযোগিতা তারা পান না। সরকারের বরাদ্দকৃত ভ্যাকসিন ও কৃমিনাশক নিয়েও রয়েছে তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ। খামারিদের ঠিকমতো দেয়া হয় না এসব ভ্যাকসিন বা ওষুধপত্র।

সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য জেলার সাতটি উপজেলায় গরুর দুধ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৮৬ হাজার টন, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১৩ হাজার টন বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৭৩ হাজার টন। এ লক্ষ্যের বিপরীতে অর্জিত হয়েছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার টন। ফলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েও ৩ হাজার টন বেশি উৎপাদন হয় দুধ। প্রতিদিন গড়ে ৯০-৯৫ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয় এ জেলায়। যার স্থানীয় চাহিদা ১২-১৪ হাজার লিটার। বাকি দুধ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়।

তালা উপজেলার জেলায়া গ্রামের দুগ্ধ খামারি দিবস চন্দ্র ঘোষ জানান, তিন দশক ধরে দুধ উৎপাদন খামার পরিচালনা করে আসছেন। প্রথমে একটি গাভী দিয়ে শুরু করলেও বর্তমান তার খামারে দুধালো গাভীর সংখ্যা ৪৫টি। এসব গাভীর মধ্যে রয়েছে ফ্রিজিয়ান, জার্সি ও হাইয়াল জাতের। একেকটি গাভীর মূল্য ২-৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। প্রতিদিন ৪৫০-৫০০ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে তার খামারে। ৩০-৩৫ জন শ্রমিক নিয়মিত তার খামারে কাজ করেন। তবে করোনা-পরবর্তী সময়ে গো-খাদ্যের যে পরিমাণ দাম বেড়েছে তাতে খামার পরিচালনা করতে গিয়ে লোকসান দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এক কেজি সয়াবিন খৈল কিনতে হয় ৭৫-৮০ টাকা, ভুট্টাবা গমের ভুসি কেজিপ্রতি ৫৫-৬০ টাকা। সেখানে লিটারপ্রতি দুধ ৪৮-৫০ টাকা দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। অথচ আমাদের কাছ থেকে ৪৮-৫০ টাকা দরে দুধ কিনে মিল্কভিটা, প্রাণ, আড়ং ও ব্র্যাকসহ অন্যান্য কোম্পানি বাজারে বিক্রি করছে ৮০-৯০ টাকায়। এতে খামারিরা লোকসান গুনছেন আর বড় কোম্পানিগুলো ফুলেফেঁপে উঠছে। অন্যদিকে খামারে গাভী অসুস্থ হলে সরকারি ওষুধ বা ভ্যাকসিন ঠিকমতো পান না। মাঝেমধ্যে দু-একটি কৃষিনাশক দিলেও অন্যান্য জরুরি ওষুধ ভ্যাকসিন দেয়া হয় না।’

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঘোষপাড়া গ্রামের দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারি আব্দুস সাত্তার নিজেকে সফল ডেইরি খামারি দাবি করে জানান, মাত্র দুটি গাভী দিয়ে নব্বাইয়ের দশকে যাত্রা। বর্তমানে তার খামারে গাভীর সংখ্যা আটটি। দুধ বিক্রির অর্থ দিয়ে এ পর্যন্ত আড়াই-তিন কোটি টাকার সম্পদ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে জেলা শহরে সেলফোনের শো-রুম, সমন্বিত কৃষি প্রকল্প ও পাকা আবাসিক ভবন। আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘ডেইরি খামার খুবই সম্ভাবনাময়। বারো মাসই দেশে তরল দুধের সংকট থাকে। দেশব্যাপী যা উৎপাদন হয় তা দিয়ে চাহিদা মেটে না। ফলে এ শিল্পে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়া যায়। এখানে ঝুঁকি কম। তবে দেশে খামারিদের উৎপাদিত দুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। মিল্কভিটা, প্রাণ বা আড়ং যে দামে দুধ বিক্রি করে তার সমপরিমাণ বা কাছাকাছি পেলেও খামারিরা লাভবান হবেন। কিন্তু বর্তমানে খামারিরা দুধের যে দাম পান তা দিয়ে টিকে থাকা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

এ ব্যাপারে মিল্ক ভিটা সাতক্ষীরা বিসিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক নভেল আক্তার জানান, সাতক্ষীরায় অবস্থিত মিল্ক ভিটার তিনটি দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রে দৈনিক প্রায় ৯-১০ হাজার লিটার তরল দুধ ক্রয় করা হয়। প্রতি লিটার ৪৮-৫০ টাকা হারে দাম নির্ধারণ করা রয়েছে। তাছাড়া এটি সমবায় কোম্পানি হওয়ায় খামারিদের আপৎকালীন অনুদান দেয়াসহ বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধা দেখা হয়। তবে দুধের দাম নিয়ে খামারি পর্যায়ে অসন্তোষ প্রশ্নে তিনি বলেন, মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের আলোচনার মাধ্যমে দুধের মূল্য বেঁধে দেয়া হয়। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই।

একই ধরনের বর্ণনা দিলেন প্রাণ গ্রুপের সাতক্ষীরা জেলার দায়িত্বরত ডেইরি ম্যানেজার ইখতিয়ার উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘সাতক্ষীরার সাতটি সেন্টার থেকে দৈনিক আট-নয় হাজার লিটার পরিমাণ দুধ সংগ্রহ করা হয়। লিটার প্রতি যার দাম দেয়া হয় ৫১-৫২ টাকা।’

সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এবিএম আব্দুর রউফ জানান, তরল দুধ উৎপাদনে খুবই সম্ভানাময় জেলা সাতক্ষীরা। এখানে দৈনিক প্রায় এক লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। যা দেশের তরল দুধ উৎপাদনকারী জেলাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। প্রথম অবস্থানে রয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলা। সরকার এরই মধ্যে লাইভ স্টক ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এলডিডিপি) নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের অধীনে খামারিরা ন্যায্যমূল্যে দুধ বিক্রি করতে পারবেন।