মাছ মানেই কি কেবল ঝোল বা ভাজি? ভোজনরসিক বাংলার জনগণের এই চিরাচরিত ধারণাকে বদলে দিয়েছেন কক্সবাজারের তরুণী নাজমা আক্তার রেশমি। পর্যটননগরীর কলাতলী ডলফিন মোড় থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে উত্তর আদর্শগ্রাম। সেখানেই গড়ে উঠেছে এক অভিনব কর্মযজ্ঞ। তাজা সামুদ্রিক মাছ দিয়ে তৈরি হচ্ছে মচমচে চিপস! শুনতে অবাক লাগলেও, রেশমির হাত ধরে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উৎপাদিত হচ্ছে ‘সামুদ্রিক মাছের চিপস’।
ইলিশ, রূপচাঁদা, কোরাল, পোপা কিংবা টুনা– গভীর সাগরের এসব মাছ এখন আর শুধু ডাইনিং টেবিলে ভাতের সঙ্গে নয়, বরং চিপস হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে ড্রয়িংরুমের আড্ডায় কিংবা শিশুর টিফিনে।
যেভাবে তৈরি হয় অভিনব এ চিপস
রেশমির কারখানায় ঢুকলেই চোখে পড়বে পরিচ্ছন্ন কর্মব্যস্ততা। প্রথমে বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয় সামুদ্রিক মাছ। এরপর ধুয়ে পরিষ্কার করে আলাদা করা হয় কাঁটা ও মাংস। মাছের সেই মাংসল অংশ বিশেষ মেশিনের সাহায্যে মিহি কিমা বা গুঁড়া করা হয়। স্বাদ বাড়াতে এর সঙ্গে মেশানো হয় লবণ, চিনি, লবঙ্গসহ নানা গোপন মসলা। এভাবেই তৈরি হয় চিপসের মূল ভিত্তি।
পরবর্তী ধাপে এই মিশ্রণ ডিপফ্রিজে রাখার হয়। পরে বিশেষ পাত্রে সেদ্ধ করা হয়। এরপর ঠান্ডা করে মেশিনের সাহায্যে নিখুঁত মাপে কেটে রোদে শুকানো হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকানো এই ‘র’ চিপসগুলো খাওয়ার উপযোগী করে বোতলজাত করা হয়। প্রতিটি বোতলে লেবেলিংয়ের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয় পুষ্টিগুণ ও উপাদানের পরিমাণ। বিএসটিআইয়ের ল্যাব টেস্টে উত্তীর্ণ রেশমির এই চিপস এখন স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের পছন্দের তালিকায়।
ব্যর্থতা থেকে সাফল্যের শিখরে
রেশমির সফল হওয়ার পথটা মসৃণ ছিল না। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রেশমি। বাবা নুরুল হক হোটেলের বাবুর্চি ছিলেন। অভাব-অনটনের সংসারে অনেক কষ্ট করে কক্সবাজার সিটি কলেজ থেকে অনার্স শেষ করেন তিনি। উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হয় ২০২০ সালে। শুরুতে ডুমুর ও বিভিন্ন ফলের আচার তৈরি করে বাজারজাত করার চেষ্টা করেন। সফলতার মুখ দেখেননি। পর্যটন এলাকায় শুঁটকির চাহিদা প্রচুর। লবণের আধিক্য ও ক্ষতিকর উপাদানের কারণে অনেকেই তা এড়িয়ে চলেন। এ ভাবনা থেকে ২০২১ সালে মাছের গুঁড়া তৈরি শুরু করেন রেশমি। সেখানেও আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। এতে দমে যাননি রেশমি। ২০২৩ সালে টুনা মাছ দিয়ে চিপস তৈরির এক অভিনব পরিকল্পনা মাথায় আসে তাঁর। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অবশেষে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাণিজ্যিকভাবে সফল হন তিনি।
শিশুর জন্য স্বাস্থ্যকর বিকল্প
বাজারে প্রচলিত চিপস নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। অতিরিক্ত তেল ও ক্ষতিকর উপাদানের কারণে শিশুরা এসব চিপস খেয়ে ভাতের রুচি হারিয়ে ফেলে। এ সমস্যার সমাধানে রেশমির ‘ফিশো’ ব্র্যান্ডের ফিশ চিপস এক জাদুকরি ভূমিকা রাখছে। রেশমি জানান, তাঁর তৈরি চিপসে আলু বা ভাজাপোড়া চিপসের মতো কোনো ক্ষতিকর উপাদান নেই। এতে রয়েছে সামুদ্রিক মাছের ‘ওমেগা-৩’ ফ্যাটি এসিডসহ নানা পুষ্টিগুণ। এটি শিশুর মুখের রুচি নষ্ট করে না; বরং প্রোটিনের চাহিদা মেটায়। এ কারণেই সচেতন মা-বাবার কাছে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘সি ফিশ ক্র্যাকার্স’।
কর্মসংস্থান ও বিপণন
রেশমি তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠান ‘ফিশো’র মাধ্যমে অনলাইনে এ চিপস বিক্রি করছেন। প্রতি কেজি চিপসের দাম রাখা হচ্ছে দুই হাজার টাকা। বর্তমানে মাসে ৩০ থেকে ৪০ কেজি চিপস বিক্রি হচ্ছে তাঁর। শুধু চিপস নয়, ফিশো তৈরি করছে ফিশবল, ফিশ সসেজ, বালাচাউ, ফিশ পাউডার ও নিরাপদ শুঁটকিসহ নানা পদ। রেশমির এই উদ্যোগে এখন আর তিনি একা নন। তাঁর সঙ্গে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন আরও কয়েকজন নারী।
আগামীর স্বপ্ন
টুনা মাছ দিয়ে শুরু করলেও এখন কাঁচামালের সহজলভ্যতার কারণে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ব্যবহার করছেন রেশমি। তাঁর স্বপ্ন–সীমিত পরিসরের এ উদ্যোগকে বড় শিল্পে রূপ দেওয়া। রেশমির বিশ্বাস, সরকারি বা বেসরকারি আর্থিক সহযোগিতা পেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে এ ‘সামুদ্রিক মাছের চিপস’ বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। কক্সবাজারের সমুদ্রতীর থেকে উঠে আসা এ উদ্ভাবনী পণ্য একদিন ছড়িয়ে পড়বে সারাবিশ্বে–এমনটাই প্রত্যাশা অদম্য উদ্যোক্তা নাজমা আক্তার রেশমির।
