
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ইছামতি নদীর তীর থেকে বিপুল পরিমাণ বন্যপাখি শিকার ও পাচারের অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (৪ মার্চ) রাতে চালানো অভিযানে ৬৯৭টি মৃত পাখি উদ্ধার করা হয়, যেগুলোকে রেস্তোরাঁয় বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করা হচ্ছিল। পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে বন্যপাখি শিকার করে সেগুলোকে কোয়েলের মাংস বলে বিক্রি করছিল।
অভিযুক্ত তিনজন হলেন আনোয়ারার আজামুল্লা পাড়ার মো. সৈয়দুল আলম (৬০), মোহরি পাড়ার মো. ইদ্রিস (৬৫) এবং পটিয়ার শোভনদন্ডি ইউনিয়নের মো. সোহেল (৩০)। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২-এর আওতায় মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং আদালতে হাজির করা হয়েছে।
আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনির হোসেন বলেন, “ইছামতি নদীর তীরবর্তী বিস্তৃত ফসলি জমিতে প্রতিদিন প্রচুর পাখি খাবারের সন্ধানে আসে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি চক্র সেখানে জাল পেতে পাখি ধরত এবং পরে সেগুলো জবাই করে গরম পানিতে চুবিয়ে পালক তুলে ফেলত। এরপর রেস্তোরাঁয় কোয়েলের মাংস বলে বিক্রি করত।”
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ মঙ্গলবার রাতে উপজেলা সদর এলাকায় একটি চেকপোস্ট স্থাপন করে। সন্দেহজনক একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা থামিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। এ সময় দুটি বড় বস্তা উদ্ধার করা হয়, যার ভেতরে শত শত মৃত পাখি詐্মুজমার করা ছিল।
ওসি আরও জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং এই চক্রের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত আছে কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, অভিযানে মোট ৬৯৭টি মৃত পাখি উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৩৫টি শালিক, ৪২২টি চড়ুই ও ১৪০টি বাবুই। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাখিগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই স্থানীয় প্রজাতির, যেগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে চড়ুই এবং বাবুই পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে সহায়ক, যা কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চট্টগ্রামের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য বলেন, “এত বিপুল সংখ্যক পাখি শিকার শুধু অবৈধ নয়, এটি পরিবেশের জন্যও মারাত্মক হুমকি। পাখিরা প্রাকৃতিক কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে এবং কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। এত সংখ্যক পাখি মেরে ফেলা হলে স্থানীয় বাস্তুসংস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
তিনি আরও বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আইনের ফাঁকফোকরের কারণে অনেক সময় এই ধরনের অপরাধীরা সহজেই জামিন পেয়ে যায়। ফলে তারা বারবার একই অপরাধ করতে থাকে।”
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুসারে, বন্যপাখি শিকার ও পাচার দণ্ডনীয় অপরাধ। এই আইনে শাস্তি হিসেবে জরিমানা কিংবা কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও বাস্তবে অনেক সময় অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়।
আইনের দুর্বলতার বিষয়ে পরিবেশবিদ দীপান্বিতা ভট্টাচার্য বলেন, “বন্যপ্রাণী পাচার একটি অ-আমলযোগ্য অপরাধ হওয়ায় অভিযুক্তরা আদালতে হাজির হওয়ার পরপরই জামিন পেয়ে যায়। ফলে তারা বারবার একই অপরাধ করে।”
তবে আনোয়ারা থানার ওসি জানিয়েছেন, এ ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং মামলাটি গুরুত্ব সহকারে পরিচালনা করা হবে, যাতে অভিযুক্তরা সহজেই জামিন না পায়।
উদ্ধারকৃত পাখিগুলো ইতোমধ্যে জবাই করা হওয়ায় সেগুলো বাঁচানোর কোনো সুযোগ ছিল না। পুলিশ জানিয়েছে, পাখিগুলো দ্রুত পচন ধরতে শুরু করেছিল, ফলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী সেগুলো মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, পাখি শিকারের মতো অপরাধ রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। অনেক সময় স্থানীয় বাসিন্দারা এই ধরনের অপরাধ সম্পর্কে জানলেও ব্যবস্থা নেয় না। ফলে অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যায়।