ঢাকা, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫, রবিবার

টেকসই কৃষির জন্য গবেষণায় গুরুত্ব দিতে হবে



গবেষণা

এগ্রিবার্তা ডেস্ক

(৩ সপ্তাহ আগে) ১০ নভেম্বর ২০২৫, সোমবার, ৭:৪০ অপরাহ্ন

agribarta

বাংলাদেশের কৃষি এখন গবেষণানির্ভর এক উৎপাদন ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে। মাঠে কৃষকের ঘাম আর গবেষণাগারে বিজ্ঞানীর মেধা– এই দুইয়ের মেলবন্ধনে কৃষি আজ এক নতুন সম্ভাবনার নাম; যাকে বলা যায় কৃষি অর্থনীতি। কৃষিবিজ্ঞানীদের হাতেই জন্ম নিচ্ছে ফসলের নতুন জাত, আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি, গবাদি পশুর উন্নয়ন পদ্ধতি, দুধ ও মাংসের মানোন্নয়ন, মৎস্যজাত উন্নত প্রযুক্তি। এমনকি কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও তারা রেখেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা। তাদের উদ্ভাবনেই পুনর্গঠিত হয়েছে কৃষকের অর্থনৈতিক ভিত্তি। কৃষি গবেষণা প্রমাণ করেছে– গবেষণার ফল কেবল কাগজে নয়, মানুষের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনতে পারে। এখন প্রয়োজন এই বিচ্ছিন্ন সাফল্যগুলোকে সমন্বিত করে একটি সুসংগঠিত জাতীয় কাঠামোয় রূপ দেওয়া।

বাংলাদেশের কৃষি এখন শুধু জীবিকার উৎস নয়, জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। বর্তমানে দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান প্রায় ১১ শতাংশ। কিন্তু কর্মসংস্থানে এর অংশ ৪১ শতাংশেরও বেশি। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, কৃষির উন্নতির কারণেই গত এক দশকে দেশে অতিদারিদ্র্যের হার ৪৯ থেকে নেমে এসেছে ১০.৫ শতাংশে। স্বাধীনতার পর দেশে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি টন। এখন তা প্রায় ৫ কোটি টন। অথচ এ সময় জনসংখ্যা বেড়েছে আড়াই গুণ, আবাদযোগ্য জমি কমেছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। উৎপাদন হয়েছে পাঁচ গুণ। এটিই কৃষি গবেষণার সাফল্যের বাস্তব প্রমাণ।


এই বিপ্লবের নেপথ্যে রয়েছে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের (এনএআরএস) ১৪টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত ৯৭২টি উচ্চ ফলনশীল ও ঘাতসহনশীল ফসলের জাত এবং ১ হাজার ৩৯২টি উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এসব প্রযুক্তি শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নয়; পুষ্টি, আয় ও কর্মসংস্থানেরও সমাধান দিয়েছে। বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে তৃতীয়, মাছ ও চা উৎপাদনে চতুর্থ, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং পাট রপ্তানিতে প্রথম স্থানে রয়েছে। এ ছাড়া আলু উৎপাদনে অষ্টম, আমে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনেও বাংলাদেশ শীর্ষস্থান দখল করেছে। তবে এই চিত্রের মাঝেই লুকিয়ে আছে অন্য বাস্তবতা।

অনেক তরুণ কৃষিবিদ এ পেশায় আগ্রহ হারাচ্ছেন। কর্মরত অনেক গবেষকই বিকল্প চাকরির দিকে ঝুঁকছেন। অথচ কৃষি গবেষণার কাজ অফিসের দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি মাঠে, ল্যাবে, কৃষকের পাশে নিরবচ্ছিন্ন এক পরিশ্রমের নাম। এই বাস্তবতা বিবেচনায় কৃষি গবেষণাকে বিশেষায়িত সার্ভিস হিসেবে

স্বীকৃতি দেওয়া এবং গবেষকদের 
জন্য বিশেষ ভাতা চালু করা সময়ের দাবি। যদি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে একইভাবে মেধাবী জনবল আকৃষ্ট ও ধরে রাখা না যায়, তাহলে কৃষির ভবিষ্যৎ উন্নয়ন থমকে যাবে। 
বাংলাদেশে গবেষণার গল্প তাই একদিকে উজ্জ্বল আলো, অন্যদিকে অনিবার্য ছায়া। আলো হলো আমাদের মেধা, উদ্ভাবনী শক্তি ও তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনা; ছায়া হলো দুর্বল সিস্টেম, স্বল্প অর্থায়ন ও নীতিগত সীমাবদ্ধতা।

গবেষণাকে আমরা প্রায়ই ব্যয় হিসেবে দেখি; বিনিয়োগ হিসেবে নয়। অথচ উন্নত দেশগুলো গবেষণাকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ মনে করে। গবেষণার মানদণ্ড যদি উদ্ভাবনের মাত্রা, সামাজিক প্রভাব ও ব্যবহারযোগ্যতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, তাহলে গবেষকরা আরও অনুপ্রাণিত হবেন পরিবর্তন আনতে। গবেষণা কোনো বিলাসিতা নয়। এটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের হাতিয়ার। যে জাতি গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেয়, তারাই ইতিহাস বদলায়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পেছনে ছিল কৃষি গবেষণার সাফল্য। লবণাক্ততা সহনশীল বা খরা প্রতিরোধী ধানের জাত শুধু কৃষকের জীবনেই নয়; রাষ্ট্রের ভবিষ্যতেও পরিবর্তন এনেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন প্রয়োজন কৃষিকে আরও উৎপাদনমুখী ও বাণিজ্যিকীকরণযোগ্য করে তোলা। এ জন্য কৃষি গবেষণায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, বেসরকারি অংশীদারিত্ব, কৃষি ইপিজেড গঠন এবং পূর্ণাঙ্গ যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য।

বাংলাদেশের কৃষি আজ শুধু চাষাবাদের ক্ষেত্র নয়; এক বিজ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির স্তম্ভ। যাদের মেধা ও শ্রমে এই সাফল্য রচিত, সেই কৃষিবিজ্ঞানীরা আজ প্রণোদনা ও স্বীকৃতির অপেক্ষায়। বাংলাদেশ আজ খাদ্য নিরাপত্তায় স্বনির্ভর। এই সাফল্যের মূল কারিগর আমাদের গবেষকরা, যারা দিনরাত মাঠে ও ল্যাবে কাজ করছেন প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে। তাদের প্রাপ্য মর্যাদা, সম্মান ও প্রণোদনা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।

গবেষণায় বিনিয়োগকে ব্যয় নয়, ভবিষ্যতের পুঁজি হিসেবে দেখতে হবে। উন্নত দেশে গবেষক মানেই জাতির সম্পদ। আমাদের দেশে তারা অনেক সময় প্রাপ্য সম্মান, সুযোগ ও সামাজিক স্বীকৃতি পান না। ফলে অনেক মেধাবী তরুণ গবেষণার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বা বিদেশে চলে যান। অথচ পর্যাপ্ত অবকাঠামো, অর্থায়ন ও মর্যাদা নিশ্চিত করা গেলে তারাই বাংলাদেশের কৃষিকে বৈশ্বিক মানচিত্রে আরও উজ্জ্বল করতে পারতেন।

ড. মো. আল-মামুন: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা

  • সমকাল

গবেষণা থেকে আরও পড়ুন

সর্বশেষ