হেমন্ত আসে ধীর পায়ে শিশির স্নাত শীতল পরশ আলতো গায়ে মেখে। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই কৃষিপ্রধান এই বাংলাদেশে সূচনা হয় নবান্ন উৎসব। ঋতুর রানী হেমন্তে নতুন ফসলের মৌ মৌ গন্ধে প্রকৃতিতে প্রশান্তির ভাব চলে আসে। ভোরের কুয়াশায় ফসলের মাঠে, গাছের পাতায়, ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশির জমে। নতুন ধানের মৌ গন্ধে ফসলের মাঠে ওড়াউড়ি করে প্রজাপতি, ভ্রমর আর ঘাসফড়িংয়ের দল। হেমন্তের ফোটে ফুল শিউলি। দোলনচাঁপাও সুবাস ছড়ায় চারিদিকে। নবান্নের ঋতু হেমন্তকে ঘিরে কবি-সাহিত্যিকরা লিখেছেন গল্প, কবিতা আর গান। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন-
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-
এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে/
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’।
সত্যিই কবিতার মতোই সুন্দও নবান্নের চিরায়ত এ্ই বাংলার গ্রামীণ রূপ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’ আবহমান এই বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধতার শুরু মা-মাটি-কৃষি থেকে। হেমন্ত নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুুর ঋতু। তাই বোধ হয় হেমন্তকে অনুভবের ঋতুও বলা হয়। আবার হেমন্তকে মৌন, শীতল বা অন্তর্মুখী ঋতুও বলা যায়। প্রকৃতির হিম হিম ভাব আর হাল্কা কুয়াশায় শীতের আগমন বার্তা নিয়ে জানিয়ে ১লা কার্তিক থেকেই শুরু হয়েছে হেমন্তকাল। এক হেমন্তের দুটি রূপ- ঋতুর শুরুতে মরা কার্তিকে অভাব আর ক্ষুধার হাহাকার; আবার শেষে অগ্রহায়নে ধানের প্রাচুর্য। প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনান দাশ যথার্থই বলেছেন- ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপর মাথা রেখে/
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে-কার্তিকের ক্ষেতে;/
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার/
চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ/
তাহার আস্বাদ পেয়ে পেকে ওঠে ধান’।
কবির বর্ণনা যেন প্রকৃতির প্রতিচিত্র। কার্তিক আর অগ্রহায়ন দুই মাস হেমন্ত কাল। এই হেমন্তের অঘ্রানে কৃষকের ঘরে নতুন আমন ফসল উঠে। একারণে হেমন্তকে বলা হয় নবান্নের ঋতু। আজ পয়লা অগ্রহায়ন। অঘ্রানে ফসলে মাঠে মাঠে কাঁচা-পাকা অপরূপ দৃশ্য মন কাড়ে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে অঘ্রানের মোহনমায়ার চিত্ররূপকেই উপস্থাপন করেছেন-
‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা খেতে, (আমি) কি দেখেছি মধুর হাসি।...’
সবুজ ফসলের মাঠজুড়ে কাঁচা পাকা ধানের আভা ছড়িয়ে শুরু হয় অগ্রহায়ণ। তাই হিমেল হাওয়ায় ভেসে আসা হেমন্তকাল সবুজ- হলুদ রঙে আমনের মৌ মৌ সুভাস ছড়িয়ে দিগন্তজোড়া আনন্দ আহবানে কৃষক পরিবারের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন ফসলের বার্তা। আমাদের জাতীয় জাতীয় সঙ্গীতে কবিগুরু যথার্তই বলেছেন-
‘ওমা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে কি দেখেছি/, ও মা কি দেখেছি মধুর হাসি...।
সত্যিই হেমন্তে অগ্রহায়ণ মাসের আগমন বাঙালি কৃষক পরিবারে যেন সেই বার্তাই দেয়। পহেলা অগ্রহায়ণ বাংলার কৃষক পরিবারের নবান্নের প্রথম দিন হিসেবে দেশজুড়ে কৃষি বিভাগের উদ্যোগে পালিত হয় জাতীয় কৃষি দিবস। তবে অগ্রহায়ণ মাসে মাঠজুড়ে ধান কাটার ধুম পড়ে। ফসল তোলার কাজে ব্যস্ত সময় কাটে কৃষক-কৃষাণীর। মানব সমাজে জীবিকার প্রয়োজনে কৃষিপ্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে। তখন থেকেই বিভিন্ন কৃষ্টি মেনে ঘরে ফসল তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। অগ্রহায়ণের শেষ দিন পর্যন্ত বহাল থাকবে হেমন্তের আধিপত্য। হেমন্তের প্রকৃতি হিম হিম ভাব নিয়ে কুয়াশার শীতল আভা ছড়িয়ে দেয়। হেমন্ত হলো ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু। শরৎকালের পর এই ঋতুর আগমন। শীতের আগাম আভাস দেয় বলে তাকে শীতের পূর্বাভাস ঋতুও বলা হয়। প্রকৃতির মায়ায় নানান রঙ-রূপের বৈচিত্র্য নিয়ে আগমন করে বলে গ্রাম-বাংলায় এই ঋতু উৎসবের ঋতু বলেও পরিচিত। প্রকৃতিতে শীতের আগমনি পূর্বাভাস পাওয়া যায় হেমন্তের শুরু থেকেই। কৃষকের কষ্টের সম্পদ ফসল তখন মাঠজুড়ে কাঁচাপাকা ধানের বর্ণিল অপরূপ সাজে কৃষকের মনে আনন্দের দোলা দেয়। এই শোভা দেখে কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে। বাড়ির আঙিনা-উঠোন পরিষ্কার করে সোনার ফসল ঘরে তোলার প্রস্তুতি নেয় কৃষক কৃষাণিরা। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষক বধূ মনের আনন্দে ধান শুকোয়। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ। বাড়ির চারপাশে লাউ, শিম, মুলা, বেগুনসহ সবজি গাছগুলো সতেজতায় প্রাণজাগায় প্রকৃতি সবুজ অঙ্গনে। ভোরের হাল্কা কুয়াশার পরশ, সকালের সোনারোদ, দুপুরের ঝকঝকে উচ্ছ্বল রুদ্দুর, বিকেলে হিমেল আভা প্রকৃতির সবকিছুতে যেন আনন্দের নতুন বার্তা ভেসে বেড়ায়।
এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো ধান উৎপাদনের ঋতু হেমন্ত দিয়ে। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ব হয়। এভাবেই হেমন্ত আসে কৃষকের দুয়ারে ফসলের হাসি নিয়ে। এ ঋতুতে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, ছাতিম, বকফুল ফোটে প্রকৃতিকে অনিন্দ্য রূপময়ী করে তোলে।
অগ্রহায়নের প্রথম দিন- অগ্র অর্থ ‘প্রথম’ আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। এক সময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। এ মাসটি বাঙালির সামাজিক জীবনে ঐতিহ্যবাহী, অসাম্প্রদায়িক বন্ধনে আবদ্ধ। যদিও আকাশ সংস্কৃতির হালআমলে অনেকটাই পাল্টে গেছে সেই অগ্রহায়নের চিরাচরিত উৎসবের রীতি। এই পালন যেন ভুলতে বসেছে আধুনিকমনস্ক কৃষক সমাজও। তথাপি কৃষি নির্ভর গ্রামবাংলার সরল জীবনযাপনের প্রতীক এই নবান্ন উৎসব একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়নি বাঙালির জীবন থেকে।
বাদশা আকবরের সময়ে পহেলা অগ্রহায়ণকে (মধ্য নভেম্বর) বাংলা নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন সমস্ত দেশ এই শস্যে ছেয়ে যেতো। সে সময়ে বেশ জনপ্রিয় এবং ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন ফসল ছিলো আউশ। অগ্রহায়ণ এর কিছুটা আগে মানে কার্তিক মাসে আউশ শস্যটি রোপণ করা হতো যার ফলে, হেমন্ত কাল এসে পোঁছাতেই শস্যের মাঠ হলুদে ছেয়ে যেত। হলুদ ফসলের মাঠ দেখে কৃষকদের মুখে ফুটে উঠত তৃপ্তির হাসি। একারনেই সে সময়টাকে উৎসবে পরিণত করা হল, নাম দেয়া হয় “নবান্ন উৎসব”। নবান্ন উৎসব মানে “নতুন চাল বা অন্নের উৎসব”। এই সময় ধান কেটে শুকিয়ে সিদ্ধ কওে তৈরি করা হয় নানা ধরনের পিঠাপুলি, পায়েস। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যয় যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। ‘নবান্ন’ মানে ‘নতুন অন্ন’। বাংলাদেশে নবান্ন শুরু হয় আমন ধান কাটার পর। আমনের নতুন ধানের চালের প্রথম রান্না উপলক্ষকে কেন্দ্র করেই নবান্ন শব্দটির জনপ্রিয়তা। অঘ্রানে নতুন ফসল পাকলে কৃষকরা ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালের এক কোণায় বেঁধে রাখেন। বাকি এই চালের পায়েসে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। এই নতুন চালের পায়েস দিয়ে মজজিদে দেয়া হয় সিন্নি। এক সময় সাড়ম্বরে নবান্ন উদযাপন হতো। এই উৎসব মানুষের ভেতরে সমাদৃত ছিল অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে। কিন্তু কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব অনেকটা স্বকীয়তা হারিয়েছে। তবে এখনো বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু স্থানে নবান্ন উৎসব অত্যন্ত ঘট করে আনন্দ মুখর পরিবেশে উদযাপন হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উদযাপন পালন শুরু হয়।
অগ্রহায়ণ মাস জুড়ে চলবে নবান্ন উৎসব। বাঙালীর প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন। এ সময় আমন ধান কাটা শুরু হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল উৎপাদনের সময় এটি। এসময় অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটে কৃষক-কৃষাণীর। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। যদিওবা যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় না আমাদের গ্রামবাংলা। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে চীন সম্রাট চিন সিং স্বয়ং মাঠে ধান বপন করে দেশব্যাপী একটি বার্ষিক উৎসবের প্রবর্তন করেন। জাপানে অতি প্রাচীনকাল থেকে সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব পালিত হয়ে থাকে এবং এ উপলক্ষে জাতীয় ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে। বঙ্গীয় এলাকায় আদিকাল থেকেই অনার্য বাঙালিরা নবান্ন উৎসব উদযাপন করতো। নানা আনুকূল্যে সে রেওয়াজ আজো চলে আসছে।
কৃষি নির্ভর গ্রাম বাংলার প্রধান কৃষিজ ফসল কাটার মৌসুম এই অগ্রহায়ন মাস। বাঙালির জাতীয় জীবনে স্মরণাতীত কাল থেকে পয়লা অগ্রহায়ণকে বিবেচনা করা হয় বছরের শুভদিন হিসেবে। এই দিনটিকে নবান্নের দিন হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এই নবান্নকেই আবার হেমন্তের প্রাণ বলা হয়। নবান্নের সাথে বাংলার কৃষি ও কৃষক পরিবারের আনন্দ, আতিথেয়তার গভীর সম্পর্ক। কেননা নতুন ধান কাটার সাথে কৃষকদের পারিবারিক জীবনের পরিবর্তনের সম্পর্ক জড়িত। এই ফসল ঘরে তুলে পরিবারের সদস্যদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ চালানো হয়। তাই প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিয়ানার পরিচয় বিস্তৃত হয়েছে এই নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে। প্রচলিত সনাতনী রীতি অনুযায়ী নতুন ধান কাটা আর সেই সাথে প্রথম ধানের অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। কনের জামাতাকে নিমন্ত্রণ করা হয় নতুন ফসলের পিঠা-পুলি, পায়েস খাওয়ার জন্য। বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয় কন্যাকে। ঘরে ঘরে নতুন চালের পিঠেপুলি আর পায়েশের আয়োজন করা হয়। এই আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যুগেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় নতুন ধানের ভাত মুখে দেওয়ার আগে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষকেরা মিলাদ আর পূজার আয়োজন করে। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতার রীতি-রেওয়াজ আছে। অমুসলিম রীতিতে, নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে। আত্মীয়স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন। নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এ নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলি’।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ এখনো গ্রামে বাস করে। গ্রামের প্রায় ৬০ ভাগ লোকের জীবন-জীবিকা এখনো কৃষি ও খামারভিত্তিক। শহরেও শতকার প্রায় ১১ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত। জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান শতকরা ১৫.৩৩ ভাগ। কৃষিখাতে কর্মসংস্থান ৪৮.১ ভাগ কর্মজীবী মানুষের। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়নের কারণে ফসলি জমি কমার পরও কৃষি ক্ষেত্রে দেশের অকল্পনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে- এটি খুবই আশার দিক। ১৯৭১ সালে যেখানে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন অসম্ভব হতো সেখানে জমি কমার পরও ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ আজ খাদ্য স¦য়ংসম্পূর্ণ। সরকারের বহুমুখি উদ্যোগ গ্রহণের ধারাবাহিকতার ফলে কৃষি এখন শুধুমাত্র ফসলের মাঠে নয়- মৎস্য, গবাদিপশু পালন, সবজি ও ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ থেকে শুরু করে ব্যতিক্রম এবং নতৃন নতুন কৃষিজ বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ ও সাফল্য দেশের সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে আশার আলো দেখাচ্ছে। ধান, পাটের পাশাপাশি খাদ্যশস্য, শাকসবজি, রকমারি ফল, সমুদ্র ও মিঠাপানির মাছ, গবাদিপশু, পোল্ট্রি মাংস ও ডিম, উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, দুগ্ধ উৎপাদন অনেক বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ব উৎপাদন তালিকোয় শীর্ষত্বের লড়াই করছে বাংলাদেশের কৃষি। কাজেই কৃষি এখন সামগ্রিক অগ্রগতির নাম।
কৃষিই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ভরসার জায়গা। করোনাকালের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যেও কৃষির সামগ্রিক উৎপাদন একথা আবারো প্রমাণ করেছে। একইসাথে আবারো প্রমাণ হলো- কৃষকরাই বাংলাদেশের নিবেদিত প্রাণ দেশপ্রেমিক। কেননা, করোনাকালে বাংলাদেশের সকল শ্রেণি- পেশার মানুষ যখন লকডাউনে ঘরবন্দি তখনো মাঠে তৎপর ছিলেন বাংলার কৃষকরা। করোনার ঝুকি নিয়েও তারা দিন রাত খেটে ফলিয়েছেন সোনার ফসল। বলতে দ্বিধা নেই কৃষকের সেই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসলই বাঁচিয়ে রেখেছে ঘরবন্দি ১৭ কোটি মানুষের জীবন। করোনায় সবকিছু স্থবির হয়ে গেলেও কৃষকরাই সচল রেখেছেন দেশের অর্থনীতির চাকা। বিভিন্ন বিশ্লেষণ বলছে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি যেসব ব্যক্তি বা সংগঠন করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরবন্দি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছে তার অধিকাংশই ছিল কৃষিপণ্য। অথচ করোনাকালে লকডাউনের সময় পরিবহন, হাট-বাজার সবকিছু বন্ধ থাকা আর ক্রেতারা গৃহবন্দি থাকায় কৃষকের উৎপাদিত পণ্য কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে। করোনার ক্ষতির মধ্যে এসেছে বন্যার দীর্ঘস্থায়ীত্ব। এরফলেও কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তারপরও কৃষকরা দমে যাননি। নিবিষ্ট মনে বাংলার কৃষকরা উৎপাদনে নেমেঠেন ফসলের মঠে। তাই একথা নির্ধিদায় বলা যায়, করোনাকালে বাংলাদেশের কৃষি খাতের এই অবদান আবারও মনে করিয়ে দিয়ে গেছে, ‘কৃষিই আমাদের আসল ভরসা’ ।
আমরা জানি বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে কৃষি, তৈরি পোশাকশিল্প এবং রেমিট্যান্সের ওপর। এদের মধ্যে তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্স উঠানামা করে। তবে কৃষি অনেকটাই স্থায়ী পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর আবহাওয়ার প্রতিকূলতা সত্বেও কৃষি কোনো না কোনোভাবে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে। করোনাকালের মহাবিপর্যয়ের মধ্যে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) পূর্বাভাসে বাংলাদেশের জন্য একটি আশার বাণী শুনিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ধান উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের যে অংশগ্রহণ তার অর্ধেক এবং জাতীয় আয়ের ছয় ভাগের এক ভাগ আসে ধান থেকে। দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ পরিবার প্রতিবছর ১ কোটি ৫ লাখ হেক্টর একর জমিতে ধান চাষ করছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির আনুপাতিক অবদান কমলেও মোট কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার এবং যন্ত্রের ব্যবহার উত্পাদন বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ এবং পরিবেশ সহিষ্ণু বিভিন্ন ফসল। কৃষির অন্যতম সাফল্য হলো- দেশে ধান উৎপাদনে এসেছে বিপ্লব। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ।
দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১৯.১% এবং কৃষিখাতের মাধ্যমে ৪৮.১% মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। আমাদের কৃষিকাজের ২১টি ধাপের মধ্যে ১৭টি ধাপের কাজ করেন নারীরা বা কৃষাণীরা। দুঃখের বিষয় হলো- এই বিপুল সংখ্যক নারী কৃষকদের কাজের স্বীকৃতি নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী , ফসলের প্রাক বপন-প্রক্রিয়া থেকে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপণনের অনেক কাজ নারী কৃষকরা এককভাবে করে থাকেন। দেখা গেছে- কৃষি খাতে ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ কাজই নারী কৃষকরা করেন বিনা মূল্যে।
প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষকরা এখানেই থেমে যাননি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষুষ্ণ শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। আমন, আউশ ও বোরো ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। ৮৫ লাখ টন আলু উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায়। সাড়ে ১০ লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্বে নবম স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বৈশ্বিক গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। বাংলাদেশ এখন চাল, আলু ও ভুট্টা রফতানি করছে।
কিন্তু এই কৃষকরা কেমন আছেন? কতটা ভাল আছেন? আমরা কি সে খবর রাখি। শহরে আমরা যারা বাস করি আমাদের প্রায় সবারই অস্তিত্বের শেকড় গ্রামের কৃষি পরিবার। আমরা সেই কৃষি পরিবারগুলোর প্রতি কতটা দায়িত্বশীল ভুমিকা রাখছি? কৃষকের নিকট থেকে পণ্য কিনতে গেলে আমরা দরদাম করি। অথচ ফাস্টফুড আর চাইনিজে বসে বিনা বাক্য ব্যয়ে অতিরিক্ত টাকা দিতেও আমাদের বিবেকে বাধে না। অথচ ফাস্টফুড আর চাইনিজে অথবা রেস্টুরেন্টে আমরা যা খাই তার সবই কৃষিপণ্য দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। আমরা জেনে বুঝে অবলীলায় কৃষককে বঞ্চিত করি, অবহেলা করি। কৃষকের মর্যাদা বাড়ানো দরকার- কারণ কৃষকই উন্নয়নের প্রাণশক্তি। বর্তমান সরকার কৃষিবান্ধব সরকার। কৃষির প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেক নজর রয়েছে। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে শহরের সব নাগরিক সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার রয়েছে বর্তমান সরকারের। তবে আমার মনে হয় কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের নায্যামূল্য নিশ্চিত না করলে সেই সুবিধা কৃষকের উপর খড়ার ঘা-এর মতোই হবে। কারণ তার আয় বাড়বে না- কিন্তু ব্যয় বাড়বে। এবিষয়টি সরকারের বিশেষ বিবেচনায় আনতে হবে। বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগ কৃষক অল্প জমির মালিক কিংবা বর্গাচাষী হওয়ায় কৃষকের এ টাকার উৎস শুধু তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য বিক্রয়মূল্য; কিন্তু কৃষক উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। কৃষকের এ কষ্টার্জিত ফসলে লাভবান হচ্ছে দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ব্যবসায়ী। প্রতিমণ ধানের দাম থেকে প্রতি শ্রমিকের মজুরির দামি বেশি। বীজতলা থেকে শুরু করে প্রতি মণ ধান ঘরে তুলতে প্রায় হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু ধান বিক্রি হয় তারচেয়ে কম দামে। এতে করে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষকদের উৎপাদনের ন্যায্যমূল্য দেওয়া উচিত। কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। প্রত্যেক ইউনিয়ন পর্যায়ে র্কষক সমবায় বা গ্রাম পর্যায়ে কৃষক সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষিজ পণ্য বিক্রি ও উৎপাদন নিশ্চিত করা দরকার। আর মধ্যস্বত্বভোগি ফারিয়াদের হাত থেকে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য আদায় নিশ্চিত করতে হবে। যে করেই হোক কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।
এস এম মুকুল, কৃষি ও শিল্প-অর্থনীতি বিশ্লেষক, writetomukul36@gmail.com
০১৭১২৩৪২৮৯৪
