ঢাকা, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, সোমবার

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ: পর্ব-২

বিপ্লবের হাতছানি কৃষিযন্ত্রের স্বর্ণ যুগ



সম্পাদকীয়

এস এম মুকুল

(৩ দিন আগে) ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৫:৩৯ অপরাহ্ন

agribarta

১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষিযন্ত্র বিপণনকারী কোম্পানি ইয়ানমার। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাপানি এ প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত কৃষিযন্ত্রের বাজার বিশ্বের ১১৯টি দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে।  তবে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে দ্বিতীয় যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। এ দেশের কৃষকেরা জমি চাষ, সেচ ও ফসল মাড়াইয়ে যন্ত্রের ব্যবহারে প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এখন শুরু হয়েছে রোপণ, ফসল কাটাসহ দ্বিতীয় পর্যায়ের যন্ত্রপাতির ব্যবহার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে ভিন্নতা আসে। বাংলাদেশে যেহেতু মাথাপিছু আয় বাড়ছে, সেহেতু কৃষি খাতে শ্রমিকসংকট তৈরি হচ্ছে। ফলে নতুন ধরনের কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের। পাশাপাশি সরকারও কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছে।

যতদূর জানা যায়, বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সূচনা ষাটের দশকে, তখন হাতে আসে পাওয়ার টিলার ও সেচপাম্প। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সরকারি উদ্যোগে ৪০ হাজার লো-লিফট পাম্প বিতরণ করা হয়। এরপর ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর সরকার আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করলে বেসরকারি খাত যন্ত্র ব্যবসায় প্রবেশ করে। যান্ত্রিকীকরণের গতি তখন থেকে বাড়তে থাকে। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৯৫ শতাংশ জমি চাষ হয় পাওয়ার টিলারে, ৯৫ শতাংশ সেচ হয় মেশিনে এবং ৭০ শতাংশ ফসল মাড়াই যান্ত্রিকভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু রোপণ ও কর্তনের ক্ষেত্রে এই অগ্রগতি এখনো সীমিত; রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার মাত্র ১২.৪ শতাংশ এবং কম্বাইন হার্ভেস্টার ১৭.৩ শতাংশ কৃষকের মধ্যে সীমিত (বিআরআরআই ও ডিএই সমীক্ষা, ২০১৮)। যদিও এই তথ্য নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।


২০২০ সালের জাতীয় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিতে বলা আছে, কৃষিকে দক্ষ, লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব খাতে রূপান্তর করা হবে। কিন্তু মাঠে দেখা যায়, অনেক সময় ভর্তুকি বণ্টনে অস্বচ্ছতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং মনিটরিংয়ের ঘাটতি প্রকৃত কৃষককে বঞ্চিত করছে।

২০১৯ সালে সরকার যান্ত্রিকীকরণে গতি আনতে ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প (২০২০-২০২৫)’ হাতে নেয়। যার বাজেট ছিল ৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে। প্রকল্পের তথ্যমতে, ৫১ প্রকার কৃষিযন্ত্রে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে পাহাড়ি ও চরাঞ্চলে এবং ৫০ শতাংশ ভর্তুকি অন্য এলাকায়। বিশেষত যে যন্ত্রগুলোতে ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেসব যন্ত্র ক্ষুদ্র বা মাঝারি কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। তবে সামগ্রিকভাবে দেশের কৃষি ব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়া অর্থনীতিতে বড় সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। কৃষিতে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি, ফসল সংগ্রহত্তোর অপচয় হ্রাস, শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুফল পাচ্ছেন কৃষকরা। তবে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকায় সাধারণ কৃষকদের মাঝে যন্ত্র ব্যবহারের প্রসারতা সেভাবে  বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এর কারণ ফসল চাষে যন্ত্রের ব্যবহারের সুবিধা সম্পর্কে প্রচারণা কম।

দেশে এখনও কৃষির গুরুত্ব অনেক বেশি। জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৭ থেকে ১৮ ভাগ। বর্তমান সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিয়েছেন কৃষিতে। বর্তমানে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারও আগের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করছেন। এখন কৃষির উন্নয়নে যান্ত্রিকীকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যান্ত্রিকীরণের প্রসার ঘটাতে সরকার উন্নয়ন সহায়তা বা ভর্তুকি দিচ্ছে। কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভবিষ্যতে ভর্তুকি আরও বাড়ানো হবে। সম্প্রতি রাজধানীর ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ( কেআইবি) তিন দিনব্যাপী জাতীয় কৃষি যন্ত্রপাতি মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।


বিশেষজ্ঞদের মতে, মোটা দাগে তিনটি কারণে দেশে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো জরুরি: কৃষিতে শ্রমিকসংকট মোকাবিলা, উৎপাদন ব্যয় কমানো ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো আর তরুণদের কৃষিতে আগ্রহী করে তোলা। ৫০০ টাকা মজুরি দিয়ে ৬০০ টাকা মণ দামের ধান চাষ সম্ভব নয়। তাই যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া কৃষকের বিকল্প নেই।


বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ হলেও কৃষি সেক্টরে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর দেশে কৃষি প্রযুক্তি যান্ত্রিকীকরণে স্বর্ণযুগের আরম্ভ হয়। ঐ বছর বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর থেকে ‘কৃষি যন্ত্রপাতির মান নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ এর শর্তগুলো শিথিল করলে দেশে পাওয়ার টিলার আমদানি বেড়ে যায়। আর এভাবে কৃষি কাজে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের স্বর্ণ যুগ শুরু হতে থাকে। অনুসন্ধানে জানা যায়, কৃষি যন্ত্রায়ণে বড় প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণ ঘটে ১৯৯৭ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে। জানাগেছে ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ির অধীনে ২৫% ভর্তুকিতে দক্ষ কৃষি প্রকৌশলীদের দ্বারা পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, শক্তিচালিত ধান মাড়াই ও ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, গুটি ইউরিয়া অ্যাপ্লিকেটর ও কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রের জনপ্রিয়করণ প্র্রকল্প চালু করা হয়। এরপর ১৩ আগস্ট ২০১৩ সালে প্রকল্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ৩০% ভর্তুকিতে শ্রমিকের ঘাটতি পূরণের জন্য ধান  রোপণ যন্ত্র (ট্রান্সপ্লান্টার), পাওয়ার টিলারচালিত বীজ বপন যন্ত্র, ধান কাটার রিপার ও মাড়াই যন্ত্র ও কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র জনপ্রিয়করণের কাজ জোরদার করা হয়। এই ধারাবাহিকতায় ভর্তুকির পরিমাণ ফেব্রæয়ারি ২০১৭ সাল থেকে হাওড় ও নিচু এলাকার জন্য ৭০% এবং বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০% বৃদ্ধি করে কৃষিযন্ত্রগুলোর জনপ্রিয় করণের কাজ অব্যাহত রয়েছে। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি বিভিন্ন  বেসরকারি ও দাতা প্রতিষ্ঠানও কৃষি যন্ত্রায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।


কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সঙ্গে প্রধানত ট্রাক্টর ও মেশিনারি সম্পৃক্ত থাকলেও অন্যান্য ইনপুট যেমন উৎপাদন, নির্বাচন, বিতরণ, ব্যবহার, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও কৃষি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং তাদের পরিচালনায় বীজ, সার, পানি, কৃষি শ্রমিক এমনকি কৃষি মৌসুম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। মাছ চাষ, দুগ্ধ খামার কিংবা পোল্ট্রি শিল্পেও বিশ্বব্যাপী বহুবিধ যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে বলেই এসব খাতে অনেক বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষতিও কমানো সম্ভব হয়েছে।

¬
গবেষণায় দেখা গেছে, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের মাধ্যমে ঘণ্টায় ২.৫ বিঘা জমিতে ধান রোপণ করা যায়। এতে কৃষকের শ্রমিক, সময় ও অর্থের সাশ্রয় হয়। চারা রোপণে যন্ত্রটি ব্যবহার করলে রোপণ খরচ ৫০ থেকে ৭৫ ভাগ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে ঘণ্টায় চার বিঘা জমির ধান কাটা যাচ্ছে। চাষাবাদ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত সবখানেই যন্ত্র তাদের সাহায্য করছে। বর্তমানে দেশে  জমি চাষ, আগাছা দমন, কীটনাশক প্রয়োগ, সেচ এবং ফসল মাড়াই এর কাজে যথাক্রমে শতকরা ৯০, ৬৫, ৮০, ৯৫ এবং ৭০ ভাগ যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব হয়েছে। কৃষির উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনতে যান্ত্রিকীকরণের প্রসার ঘটাতে হবে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ করতে পারলে দারিদ্র্য কমে আসবে
বর্তমানে খাদ্যশস্যের উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এসব পণ্য উৎপাদন ব্যয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে চাষিদের লাভের পরিবর্তে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। এ জন্য প্রয়োজন কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। আর কৃষিযান্ত্রিকীকরণ করতে হলে ব্যাংকগুলোকে কৃষকদের জন্য বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে উৎপাদন ব্যয় কমে আসবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হলে বার্ষিক ৪ থেকে ৪.৫ শতাংশ হারে কৃষি প্রবৃদ্ধি হতে হবে। কৃষিখাতে কর্মীপ্রতি জিডিপি ১ শতাংশ বৃদ্ধি করা গেলে দারিদ্র্যতা কমবে ০.৩৯ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকার কৃষির যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্যে প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকদের যন্ত্রক্রয়ে ভর্তুকি প্রদান করছে। বেসরকারি খাতকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদানের জন্য কৃষিযন্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে রয়েছে বিশেষ শুল্ক সুবিধা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ কৃষি ও পল্লীঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচিতে কৃষি যন্ত্রপাতি খাতে ঋণ প্রদানকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে কেন্দ্র করে একটি উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যাদের হয়তো কোনো জমি নেই। কিন্তু তারা যন্ত্র কিনে প্রান্তিক কৃষকদের সেবা দিচ্ছে। এভাবে একটি সার্ভিস মডেল তৈরি হয়েছে। ফলে কৃষক যন্ত্র না কিনেও ভাড়া দিয়ে যান্ত্রিক সেবা নিতে পারছে। এতে প্রথাগত পদ্ধতির চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ কম খরচ পড়ছে। ফলে তাদের উৎপাদন ব্যয়ও কম পড়ছে। আবার উৎপাদন-পরবর্তী ফসলের ক্ষতি কমে আসছে যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে। যেমন হাতে ধান কাটলে ১০-১৫ শতাংশ ফলন নষ্ট হয়। কিন্তু হারভেস্টার দিয়ে কাটলে এটা ২-৩ শতাংশে নেমে আসে। এতে  কৃষক ধান বেশি পাচ্ছে। আবার হাওর এলাকায় আক¯িœক বন্যার কারণে কম সময়ে দ্রæত ধান কাটতে হয়, যা হারভেস্টার দিয়ে করা যায়। কিন্তু একটা কম্বাইন হারেভেস্টারের দাম হয়তো ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু কৃষক অনেক সময় এটা কেনার সামর্থ্য রাখেন না। তাই অল্প ভাড়া দিয়ে তারা এটার সেবা নিতে পারেন।

এস এম মুকুল,  কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাংবাদিক।
ইমেইল : writetomukul36@gmail.com,
01712342894

সম্পাদকীয় থেকে আরও পড়ুন

সর্বশেষ