কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমছে, কৃষি শ্রমিকরা শহরমুখী হচ্ছে তারপরও কৃষি অর্থনীতি সমৃদ্ধ হওয়ার পেছনে রয়েছে কৃষিযান্ত্রিকীকরণের বিশেষ অবদান। হালের বলদ, লাঙল-জোয়ালের উপর কৃষকের ভরসার সেদিন এখন আর নেই। আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় নতুন নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহারে দেশের কৃষিখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এসব যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে কৃষকের কমেছে শ্রম ও খরচ, অপরদিকে কয়েকগুণ বেড়েছে উৎপাদন। দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়তই কৃষি কাজে শ্রমিকের অভাবে কৃষকরা সঠিক সময়ে ফসল জমিতে লাগাতে না পারার ফলে কৃষকদের মাঝে কৃষি কাজে যন্ত্র ব্যবহারের ব্যাপক চাহিদা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কৃষি কাজের যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বিভিন্ন সূত্র বলছে, বাংলাদেশে কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের বার্ষিক বাজার প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। যার প্রায় পুরোটাই বিদেশিদের দখলে। ফলে যন্ত্রপাতি আমদানি বাবদ বড় অঙ্কের টাকা চলে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোর হাতে। স্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিসরে ছোট ছোট কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করছে।
একইকারণে স্থানীয়ভাবে তৈরি এসব কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদার বৃদ্ধির ফলে গড়ে ওঠেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি কারখানা। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে বর্তমানে ৯৫ ভাগ জমি চাষ হচ্ছে। বালাইনাশক ব্যবহারে ৯০ ভাগ, ফসল মাড়াইয়ে ৭৫ ভাগ যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ যে সব যন্ত্রপাতির দাম কম সে সব যন্ত্রেরও ব্যবহার বেশি। এ দিকে সার প্রয়োগে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে ৩ ভাগ, চারা রোপন ১ ভাগ, ফসল কাটা ১ ভাগ, এগুলোর বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ) ফার্ম পাওয়ার অ্যান্ড মেশিনারি বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জমি চাষে এখন প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়া লাগলেও পিছিয়ে রয়েছে ট্রান্সপ্লান্টিং ও হারভেস্টিং। মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ জমিতে ট্রান্সপ্লান্টিং করতে ব্যবহার করা হচ্ছে যন্ত্রের। অন্যদিকে মাত্র শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ জমিতে হারভেস্টিং করতে ব্যবহার করা হচ্ছে যন্ত্রের। যন্ত্রের ব্যবহার না থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন কৃষক।
দেশের কৃষকরা যাতে ভালোভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারে সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ভালো কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশীয় উৎপাদন বা শিল্প বিকাশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি এবং সুলভ মূল্যে কৃষকের কাছে দেশে উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতি পৌঁছে দিতে সরকার বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে খুচরা কৃষি যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক হার ৬৩ ভাগ থেকে কমিয়ে ১ ভাগ নির্ধারণ করেছে। এর ফলে কৃষক কম মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে পারবেন।
যান্ত্রিকীকরণে উৎপাদন খরচ কমে
কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই মোটরসের হিসাব অনুযায়ী, ১ একর জমি চাষে সনাতন পদ্ধতিতে খরচ হয় ৩ হাজার টাকা। এটা পাওয়ার টিলারে নেমে আসে ৩১০ টাকায়। আর টাক্টরে ৫৭৫ টাকা ব্যয়ে চাষ করা যায় সমপরিমাণ জমি। ফসল কাটার ক্ষেত্রে ১ একর জমিতে সনাতন পদ্ধতির খরচ ৮ হাজার ৪০০ টাকা। একই জমিতে ফসল কাটার যন্ত্র বা রিপার মেশিনে খরচ ৩৮৫ টাকা। কাটা ও মাড়াই বাবদ কম্বাইন্ড হারভেস্টরে ব্যয় ১ হাজার ১০০ টাকা। বিএইউর কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের এক গবেষণা অনুযায়ী, ১ হেক্টর জমিতে বীজ, জমি তৈরি, সারের দামসহ ধান রোপণে ট্র্যান্সপ্ল্যান্টার মেশিনের খরচ ১৪ হাজার ৮৮১ টাকা। সনাতন পদ্ধতির ব্যয় ২৪ হাজার ৪৪৫ টাকা।
কৃষিযন্ত্রের ব্যবহারে সুফল পাচ্ছেন কৃষকরা
যান্ত্রিকীকরণের বহুবিধ সুবিধাদির ফলে কৃষক দিন দিন কৃষিযন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে কৃষকদের ফসল উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে একটা ফসল থেকে আর একটা ফসল লাগানোর মধ্যবর্তী সময় কমে যাওয়ায় কৃষকরা বছরে এখন ২টা ফসলের স্থানে ৩টা ফসল অনায়াসেই করতে পারছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কৃষি প্রকৌশলীদের মতে, ধান ফসল যদি যান্ত্রিক উপায়ে কর্তন বা রিপার দ্বারা কর্তন করা সম্ভব হয়, তবে কৃষকদের প্রায় ৮৪৫০০০ মে. টন ধান সাশ্রয় হবে। এক গবেষণায় জানা যায়, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকার খাদ্য শস্য নষ্ট হয় শুধুমাত্র পরিকল্পিতভাবে ফসল কর্তন, ফসল কর্তনোত্তর ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে। কৃষি প্রকৌশলীদের গবেষণায় আরো জানা যায়, বিগত দশকে দেশে ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২,৫০,০০০ কোটি টাকা।
দেশের কৃষিকে দীর্ঘমেয়াদে আধুনিক ও টেকসই রূপ দিতে সরকার ২৫ বছরের একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে। ভবিষ্যতের ঝুঁকি, প্রযুক্তির অগ্রগতি- সবকিছু মিলিয়ে এ সমন্বিত কাঠামো তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ডিসেম্বও ২০২৫ এ চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হয়ে যাবে। ২৭ নভেম্বও ২০২৫ ‘কৃষি ও খাদ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথম দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব তথ্য জানান কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান।
ইউএসএআইডির অর্থায়নে বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অ্যাপ্রোপ্রিয়েট স্কেল মেকানাইজেশন ইনোভেশন হাব কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের মাধ্যমে যদি ধানের চারা রোপণ করা হয়, তাহলে কৃষকের শতকরা ৫০ ভাগ চারা রোপণ খরচ বাঁচায়। রিপার ও কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা হলে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে যথাক্রমে ৩৬ ও ৫৩ ভাগ খরচ বাঁচায়। অপরদিকে সনাতন পদ্ধতিতে ধান কাটা হলে ধানের অপচয় হয় শতকরা ৬.৩৬ ভাগ। কিন্তু যন্ত্রের মাধ্যমে ধান কাটা হলে ধানের অপচয় হয় মাত্র শতকরা ১.২৭ ভাগেরও কম। ধান কাটা-পরবর্তী ধান মাড়াই, শুকানো ও সংরক্ষণের সঠিক পদ্ধতি বা প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে ব্যবহৃত না হওয়ায় শতকরা ১৪ ভাগের ওপরে ধানের অপচয় হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধান শুকানো ও সংরক্ষণ করলে ধানের এ অপচয় ৮ ভাগে নামিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। অপর এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, কৃষিতে যন্ত্রায়ন ও কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় শতকরা ১৫ ভাগ, শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধি পায় শতকরা প্রায় ২০ ভাগ, সার ও বীজের সাশ্রয় ঘটায় শতকরা প্রায় ২০ ভাগ এবং সময় ও শ্রম বাঁচায় শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ। বারির ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক জরিপে দেখা গেছে, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের শুধুমাত্র বারি গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র ও মাড়াই যন্ত্র ব্যবহারের ফলে ইউরিয়া সাশ্রয় ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি সাশ্রয় বাবদ ৭৩৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
কৃষকের অনুপ্রেরণা সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি
কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে দেশের শস্য উৎপাদন বিগত ২৫ বছরে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি অর্জন সম্ভব হয়েছে। তবে শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কৃষি যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবস্থাপানার অভাবে প্রতি বছর মোট খাদ্য শস্য উৎপাদনের ৭-১০ ভাগ অপচয় হয়।
কৃষিবান্ধব সরকারের সময় উপযোগী নীতি, ফসলের উন্নত জাত এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ফসল উৎপাদনের ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কর্তনপূর্ব, কর্তনকালীন ও কর্তনোত্তর সময়ে ফসলের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে দানাশস্যে ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতির পরিমাণ মোট উৎপাদনের ১২-১৫ ভাগ, যা ফল ও শাকসবজির ক্ষেত্রে প্রায় ২৫-৪০ ভাগ। ধারণা করা হচ্ছে কৃষি কাজের প্রতিটি স্তরে কৃষি যন্ত্র ব্যবহার নিশ্চিতকরণ করা হলে বছরে আরো ৭০ মিলিয়ন খাদ্যশস্য উৎপাদন বেশি হতো। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, উন্নত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগে শস্য উৎপাদনের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রাপ্ত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানোর মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। দেখা গেছে, কৃষি যান্ত্রিকীকরণে চাষের পর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় বীজ বপন, গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ, শস্য কর্তন, শস্য মাড়াই, শস্য ঝাড়াই সহ অন্যান্য কার্যাবলিতে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার। তাই একটা ফসল কাটার পর আর একটা ফসল লাগানোর মধ্যবর্তী সময় না কমালে কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ জমি এখন পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর দ্বারা চাষ করা হয়। আগাছা নিধন, কীটনাশক প্রয়োগ ও মাড়াই কার্যক্রম যথাক্রমে শতকরা ৬৫, ৮০ ও ৭০ ভাগ বিভিন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি যন্ত্রপাতি এবং এর খুচরা যন্ত্রাংশের একটি বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে, যার পরিমাণ যথাক্রমে ৯০৭ মিলিয়ন ও ৩০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ধান উৎপাদনে চারা রোপণ ও ধান কাটায় কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার এখনো উল্লেখযোগ্য হারে হয়নি, যা শতকরা ১ ভাগেরও কম। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে ফসল উৎপাদন, ধান কাটা ও কর্তন-পরবর্তী কাজগুলোয় সঠিক যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে অপচয় রোধ করে বাংলাদেশের জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।
তারপরও এক গবেষণায় জানা যায়, বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৭ ভাগ গম, ১২.০৫ ভাগ তেল বীজ, ২৫ ভাগ শাকসবজি এবং আলু, ১২.০৫ ভাগ ডাল ফসল এবং ১০.০৫ ভাগ মরিচ ফসলে কর্তনোত্তর ক্ষতি হয় শুধু দক্ষ যন্ত্রপাতি ব্যবহারের না করার ফলে। দেশে বিপুল বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষি যন্ত্রায়ণের ওপর বিশেষ জোর দেওয়ার কোনো বিকল্প নাই। একইসাথে মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবজি উৎপাদন, মৎস্য চাষ ও পশুপালনেও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।
এস এম মুকুল, কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাংবাদিক।
ইমেইল : ৎিরঃবঃড়সঁশঁষ৩৬@মসধরষ.পড়স,
০১৭১২৩৪২৮৯৪
