পলিনেট হাউস বা কৃষিঘরে চাষাবাদ করে নতুন সুযোগ ও সম্ভবনার সন্ধান পেয়েছেন চাষিরা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি পলিনেট হাউস বা কৃষিঘর। এই বিশেষ ধরনের কৃষিঘরে বছরজুড়েই সবজি চাষাবাদ করছেন কৃষক। গ্রীষ্মকালেও উৎপাদন করা হচ্ছে শীতকালীন সবজি। সমকালে প্রকাশিত এই বিশেষ রিপোর্টে বলা হয়, পলিনেট হাউসে চাষাবাদ করতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের দরকার পড়ে না। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে পোকার আক্রমণ হয় না। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করা হয়।
ফলে এভাবে উৎপাদন করা সবজির চাহিদাও বেশি থাকে বাজারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় ২০২৩ সালে শেরপুর সদরে দুটি পলিনেট হাউস তৈরি করে। যেখানে সবজি চাষ ও চারা উৎপাদন করে সাফল্য পেয়েছেন কৃষক কামরুল হাসান ও উদ্যোক্তা ফেরদৌস মিয়া। সরকারি উদ্যোগে তৈরি করা এই কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চমূল্যের ফসল ফলানোর গল্প এখন কৃষকের মুখে মুখে। তাদের সাফল্য দেখে এলাকার অন্য চাষিরাও এই পদ্ধতিতে চাষাবাদের আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সরকারি সহযোগিতা পেলে পলিনেট হাউস তৈরি করে ফসল ফলাতে চান তারা।
কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সময় যত যাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে কৃষি। পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশে বাড়ছে জনসংখ্যা। বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই গবেষণা করে নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা চলমান রয়েছে বিশ্বজুড়েই। পলিনেট হাউস তেমনই এক গবেষণার ফসল। এই কৃষিঘর সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি নিয়ন্ত্রণ, ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ ও প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে ফসল রক্ষা করে।
পলিনেট হাউস তৈরি করতে প্রয়োজন তাপমাত্রা সহনশীল বিশেষ পলিথিন, নেট, লোহা অথবা বাঁশ দিয়ে। কৃষি জমির চারপাশে নেট দিয়ে ঘেরা হয়। এর ওপরের অংশে থাকে পলিথিন। যাতে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
চারা উৎপাদনের জন্য জৈবসার আর নারিকেলের খোসা পচিয়ে তৈরি করা হয় এক ধরনের প্রাকৃতিক তন্তু, যা হালকা ওজনের এবং পানি ধারণের ক্ষমতা রাখে। এটিকে বলা হয় কোকোপিট। এটি মাটির বিকল্প হিসেবে বা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে বীজতলা তৈরি হয়। পলিব্যাগ ও পলিনেট হাউসের আবদ্ধ পরিবেশে মাটি দ্রুত শুকিয়ে যায়, কোকোপিট অতিরিক্ত পানি ধরে রেখে গাছকে দীর্ঘ সময় আর্দ্র রাখে। ফলে ঘন ঘন পানি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। এটি মাটিকে ঝুরঝুরে রাখে, ফলে শিকড় সহজে বাতাস পায়, এতে পচনশীল রোগ কম হয়।
পলিনেট হাউসের ভেতরে যেসব সবজি চাষ করা হয় সেগুলোর প্রয়োজন অনুযায়ী তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর ভেতরের অংশে চাষাবাদের জন্য পলিমাটি, ছাই, গোবর সার, খৈলসহ নানা উপকরণ মিশ্রণে প্রস্তুত করা হয় চাষের জমি। সেখানে পলিথিনের আচ্ছাদন ব্যবহার করায় সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি ভেতরে প্রবেশে বাধা পায় এবং অতিবৃষ্টি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ফসল ও চারা অক্ষত থাকে।
পলিনেট হাউস তৈরির ফলে সারা বছর ধনেপাতা, ফুলকপি, ক্যাপসিকাম, ব্রুকলি, চালকুমড়া, পুদিনা পাতাসহ অসময়ের সবজির পাশাপাশি চারা উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে গ্রীষ্মকালেও চাষাবাদ হচ্ছে শীতকালের সবজি। চাষাবাদে এসেছে বৈচিত্র্য, কৃষকের আয়ের পথ সুগম হয়েছে।
এই কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাষাবাদে সাফল্য পেয়েছেন শেরপুর সদর উপজেলার দিঘলদি মোল্লাপাড়া গ্রামের কৃষক কামরুল হাসান। প্রায় তিন বছর আগে তাদের গ্রামে ১০ শতাংশ জমির ওপর একটি পলিনেট হাউস তৈরি করে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সেখানে সবজি উৎপাদনের দায়িত্ব নেন কামরুল।
তাঁর ভাষ্য, গত তিন বছরে পলিনেট হাউসে সবজি চাষ করে ১৫-১৬ লাখ টাকা আয় করেছেন তিনি। গেল দুই মাসে দেড় লাখ টাকার বেশি ধনেপাতা বিক্রি করেছেন। এতে খরচ বাদে তাঁর লাভ হয়েছে ১ লাখ টাকা। অসময়ে তিনি ৪০০ টাকা কেজি দরে ধনেপাতা বিক্রি করেছেন। সর্বনিম্ন ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে শেষ হয় তাঁর ধনেপাতা। প্রতি মাসে ৬ মণ করে পাতা হয়েছে। গড়ে প্রতি মণ ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। ১ মাসে ৭২ হাজার টাকার ধনেপাতা বিক্রি করলে খরচ বাদ দিয়ে তার লাভ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া শীত শুরু হওয়ার আগে তিনি ১ কেজি ফুলকপি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। বর্তমানে পলিনেট হাউসে চাল কুমড়া হচ্ছে। ১ লাখ টাকার কুমড়া বিক্রির আশা করছেন তিনি।
সাফল্য পেয়ে নিজের ১২ শতাংশ জমিতে ৩ লাখ টাকা খরচ করে একটি পলিনেট হাউস তৈরি করেছেন কামরুল হাসান। ভবিষ্যতে আরও ২ বিঘা জমিতে পলিনেট হাউস তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
চরমোচারিয়া ইউনিয়নের টালিয়াপাড়ায় আরেকটি পলিনেট হাউসে চারা উৎপাদন করছেন বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও উদ্যোক্তা ফেরদৌস মিয়া। ২০২৩ সালে জেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় ১২ শতক জমিতে এই পলিনেট হাউস তৈরি করা হয়। যেখানে সারা বছর নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় প্রায় ৬০ হাজার কীটনাশকমুক্ত সবজির চারা উৎপাদন করছেন। আড়াই লাখ টাকা খরচে বছরে তাঁর লাভ হচ্ছে ৫ লাখ টাকা।
উদ্যোক্ত ফেরদৌস মিয়ার লক্ষ্য বৃহৎ বাণিজ্যিক চারা উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা। তিনি বলেন, সিডলিং ট্রেতে কোকোপিট ব্যবহার করে সারাবছরই মৌসুমভিত্তিক সুস্থ ও উন্নতমানের সবজির চারা বিক্রি করছেন। বিশেষ করে অসময়ে গ্রীষ্মকালীন মরিচের চারা বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়েছেন। চলতি মৌসুমে দেড় লাখ মরিচের চারা বিক্রি করেছেন। একটি চারা তৈরি করতে খরচ হয় ১ টাকা ৩০ পয়সার মতো। বিক্রি করছেন ২ টাকায়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছেন তিনি। তাঁর আরও ৬৫ শতক জমি রয়েছে। পরিকল্পনা করছেন আরও দুই থেকে তিনটি পলিনেট হাউস নিজ খরচে তৈরি করবেন।
ফেরদৌস মিয়ার পলিনেট হাউসে একজন ম্যানেজার ও চারজন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। কর্মচারী জরিনা, খাদিজা, নাসিমা ও বাবুল মিয়া জানান, এখানে কাজ করে তাদের সংসার চলে। সন্তানদের লেখাপড়া করান।
স্থানীয়রা জানান, অসময়ে সবজির চাহিদা বেশি থাকে। বাজারে দামও বেশি থাকে। এই পদ্ধতিতে আগাম সবজি চাষ করতে পারলে লাভবান হতে পারবেন কৃষক। পাশাপাশি সবজির চাহিদাও পূরণ হবে। এ কারণে পলিনেট হাউস পদ্ধতিতে চাষাবাদে আগ্রহ বাড়ছে।
পলিনেট হাউস তৈরি করার আগ্রহ দেখিয়েছেন টালিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক শহীদ মিয়া। তিনি বলেন, এখানে সারাবছর চারা উৎপাদন করা সম্ভব। দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নেই। কৃষক চারা নিয়ে লাভবান। বিক্রেতাও বেশ মুনাফা পাচ্ছেন। এমন একটি পলিনেট হাউস করার স্বপ্ন আছে তাঁর। সরকারি সহযোগিতা পেলে দ্রুত উদ্যোগ নেবেন।
শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পলিনেট হাউসে সবজির চারা ও সবজি দুটিই হয়। অসময়ে সবজি চাষ করে কৃষক অধিক লাভবান হন।
বিশেষ করে বর্ষাকালে উচ্চমূল্যে সবজি বিক্রি করতে পারেন কৃষক। এ ছাড়া সারা বছরই চারা পাওয়া যায়।
