ধানের খড়, পাট ও কচুরিপানায় তৈরি পণ্য যাচ্ছে ২৬ দেশে

সমকালীন কৃষি/
এগ্রিবার্তা ডেস্ক

(১০ মাস আগে) ১৩ মে ২০২৩, শনিবার, ৭:২৮ পূর্বাহ্ন

agribarta

ধানের খড়, পাট, হোগলা ও কচুরিপানা দিয়ে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব শতাধিক ধরনের পণ্য। এর মধ্যে রয়েছে ফ্লোর ম্যাট, প্লেস ম্যাট পাপোশ, টুপি, ফুলের টব, ঝুড়ি, টিফিন বক্স, টিস্যু বক্স, ব্যাগসহ শতাধিক পণ্য। রাজবাড়ীর বরাট ইউনিয়নের ভবদিয়ায় গড়ে ওঠা গোল্ডেন জুট প্রডাক্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানে এসব পণ্য তৈরি হচ্ছে। উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য রফতানি হচ্ছে চীন, জাপান, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্টেলিয়া, সৌদি আরবসহ অন্তত ২৬টি দেশে।

ধানের খড়, পাট, হোগলা, কচুরিপানা কোনো কিছুই যে ফেলনা নয় তার প্রমাণ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিষ্ঠানটি তৈরি হওয়ায় কর্মসংস্থান হয়েছে আশপাশের দুই হাজারের বেশি শ্রমিকের। এখানে উৎপাদিত পণ্য রফতানিতে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।

গোল্ডেন জুট প্রডাক্টের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে রাজবাড়ী শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে বরাট ইউনিয়নের ভবদিয়ায় অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী হাকিম আলী সরদার নিজের এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এমন কিছুর করার চিন্তা থেকেই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। নিজের তিন একর জমি, জমানো কিছু টাকা ও ইসলামী ব্যাংকের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন গ্লোবাল গোল্ডেন জুট অ্যান্ড ক্রাফট লিমিটেড। বর্তমানে এখানে নিয়মিত কাজ করছেন ৮০০ শ্রমিক। আর চুক্তি ভিত্তিতে কাজ করছেন আরো ১ হাজার ২০০ শ্রমিক। এসব শ্রমিকের বেশির ভাগই পদ্মায় ঘরবাড়ী হারিয়ে নিঃস্ব।

গোল্ডেন জুট প্রডাক্ট নামের ওই কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা। এ সময় শ্রমিক কালাম মিয়া বলেন, ‘আমি একসময় ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতাম। ঢাকায় কাজ করে আমি যে বেতন পেতাম রাজবাড়ীতেও সে বেতন পাচ্ছি। অসুবিধা হয়েছে ঢাকায় বাসা ভাড়া ও অন্যান্য ব্যয় করে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েছি। আর এখানে নিজের বাড়িতে থেকে কাজ করতে পারছি। এখন অনেক ভালোভাবে দিন কাটছে।’

শ্রমিক সোহেল রানা বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠার কারণে জেলার বেকার সমস্যা কিছুটা হলেও কমেছে।’

হাসি আক্তার নামে অন্য এক শ্রমিক বলেন, ‘আগে স্বামী একা কাজ করতো, এখন আমি নিজেও কাজ করি। দুজনের আয় দিয়ে আমাদের সংসার ভালোভাবে চলছে। সন্তানদের পড়াশোনা করাতে তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। প্রতিদিন সকাল ৮টায় আসি আর বিকাল ৫টায় ফিরে বাড়ির কাজ করি।’

স্মৃতি আক্তার নামে অন্য এক শ্রমিক বলেন, ‘সর্বনাশা পদ্মার ভাঙনে ঘরবাড়ি জমিজমা সব হারিয়েছি। বাড়ির কাছে এ কারখানায় চাকরি করে এক বছরে ৮৫ হাজার টাকা জমিয়েছি। এখন একটু জমি কিনে ঘর তোলার স্বপ্ন দেখছি। আমার মতো অনেক নারী আছেন যারা এখানে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।’

কারখানাটিতে কাজ করছেন ১২ জন প্রতিবন্ধী নারী ও পুরুষ। কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ায় তাদের পরিবারও চলছে ভালোভাবে। তাদেরই একজন রেহেনা পারভীন। তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রী দুজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় কেউ আমাদের কাজ দিত না। এখন এখানে কাজ করে চার সন্তানের পড়ালেখার খরচের পাশাপাশি ভালোভাবে সংসার চালাতে পারছি। ’

গোল্ডেন জুট প্রডাক্টের মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা সাইদ হোসেন বলেন, ‘আমরা মূলত উৎপাদিত পণ্য বেশি রফতানি করে থাকি। কারণ বিদেশে পরিবেশবান্ধব এসব পণ্যের চাহিদা বেশি। ক্রেতারা অর্ডার করার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা পণ্য পাঠিয়ে দিই। গুণগত মান ভালো হওয়ায় আমাদের পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।’

গোল্ডেন জুট প্রডাক্টের ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাঁচামাল হচ্ছে ধানের খড়, পাট, হোগলা ও কচুরিপানা। রাজবাড়ীতে প্রচুর পাট চাষ হয় তাই এখানে থেকে পাট ক্রয় করা হয়। আর কুমিল্লা থেকে হোগলা কিনে আনা হয়। এলাকার প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, অসহায় মানুষ যে যে ধরনের কাজ করতে পারছে তাকে সেই কাজ দিয়েই কর্মসংস্থান তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ করে নদী ভাঙন এলাকা হওয়ায় কাজ পেয়ে এলাকার মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে।’

গোল্ডেন জুট প্রডাক্টের জেনারেল ম্যানেজার আলাউদ্দিন শুভ বলেন, ‘‌এতদিন পাট হোগলা দিয়ে নানা ধরনের পণ্য তৈরি হলেও এ বছর যুক্ত হয়েছে ধানের খড় ও কচুরিপানা। আমরা গ্রাম পর্যায়ে থেকে ধানের খড় ও কচুরিপানা কিনে এনে সেগুলো দিয়ে ব্যবহারোপযোগী বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছি। যেগুলো বিশ্বের ২৬টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে।  

রাজবাড়ীর বিসিক শিল্প নগরীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক চয়ন বিশ্বাস বলেন, ‘বিসিক থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা হচ্ছে। আর গোল্ডেন জুট প্রডাক্টের পণ্যের কারণে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে। কর্মসংস্থান হয়েছে। আমরা মাঝেমধ্যে কারখানাটি পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিই।’

রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক আবু কায়সার খান বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব এসব পণ্য তৈরির উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। কারখানা এলাকায় বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দিক খেয়াল রাখা হচ্ছে।’