জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের ধনী ও অতি মুনাফালোভী শিল্পোন্নত দেশগুলো দায়ী হলেও এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো এবং বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। ঝুঁকির তালিকায় ছয়টি দক্ষিণ এশীয় দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ হবে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ২.৫ শতাংশ এবং ২১০০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) প্রায় ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সামষ্টিক উদ্যোগ গ্রহণ করলে ক্ষতির পরিমাণ ২১০০ সাল পর্যন্ত জিডিপির ২ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে।
জলাবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ব্যয় নিরূপণ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশের বর্তমানে জিডিপির পরিমাণ প্রায় ১৩০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান জিডিপির ৯ দশমিক ৪ শতাংশে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। এ বিষয়ে ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসির) সদস্য কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের ভাষ্য হলো, বাংলাদেশ যে নাজুক অবস্থার মধ্যে আছে, তাতে সরকার এখনই পদক্ষেপ না নিলে আগামী শতাব্দী আসার আগেই দেশে বড় ধরনের কৃষি অর্থনীতির বিপর্যয় ঘটবে।
কমে যাবে কৃষিজমি ও কৃষিজীবীর সংখ্যা। বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য খাদ্যঘাটতি দেখা দেবে। বাংলাদেশের মোট জনশক্তির প্রায় ৫৫ শতাংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত। অত্যাধিক বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, দাবদাহ এবং উৎপাদন মৌসুমের সময় কমে যাওয়ার মতো কারণে খাদ্য শষ্য উৎপাদন বর্তমান সময়ের চেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ কমে যেতে পারে।
এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ফলে কৃষকদের অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিলে জলাশয়ের পানি দূষণ বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্যের নিরাপত্তা বিনষ্টের জন্য কম দায়ী নয়। দেশের ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি উপকূলীয় অঞ্চলে ৩ কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদের বর্তমানের চেয়ে বেশি ঝড়ের মুখোমুখি হতে হবে। আবার সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্রচুর কৃষিজমি নদীভাঙনের শিকার হয়ে বিলীন হয়ে যাবে।
বিভিন্ন কারণেই প্রতিনিয়ত কৃষি জমির পরিমাণ কমছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান ও গবেষণা কেন্দ্রের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার ল্যাবের গবেষক -মুখ্য বিজ্ঞানী ড. মো. লতিফুল বারীর মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কমানোর জন্য দুই ধরনের উপায় গ্রহণের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। প্রথমত, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, যা বাংলাদেশের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ জন্য বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। দ্বিতীয়ত : উন্নত দেশগুলোর দেওয়া জলবায়ু তহবিলের অর্থ যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষয়-ক্ষতি কমিয়ে আনা। তাই নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
যদিও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের গবেষণা বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট, পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতার প্রয়োজন।
জলবায়ুু পরিবর্তনের কারণে কৃষি জমির মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে, ভূমিক্ষয় বাড়ছে এবং জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। অতিরিক্ত কেমিক্যাল সার, অতিবৃষ্টি, খরা, এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনের ফলে মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে, যা শস্য উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর ফলে, মাটির স্বাস্থ্য এবং উৎপাদনশীলতা উভয়ই কমে যাচ্ছে, ফসল উৎপাদন কমছে, কৃষকের আয় কমে যাচ্ছে, খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকির সম্মুখী হচ্ছে, পাশাপাশি জলজ পরিবেশ বাস্তুতন্ত্র জীববৈচিত্র্য ঝুঁকির মধ্যেই থাকছে।
মাটির উর্বরতা ঘাটতিতে দেশের ৭৫-৮০% চাষযোগ্য জমির, রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি চাষাবাদ ও খাদ্য নিরাপত্তায় নানা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যেমন-অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার মাটির স্বাস্থ্যের ঘাটতি বা দূষণ, নদী-নালা, জলাশয়ের পানি, বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে এবং অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ও উচ্চ তাপমাত্রা ফসলের ক্ষতি করছে। এর ফলে খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে, খাদ্যবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে এবং কৃষকরা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে পড়ছেন। এই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ক্লাইমেট স্মার্ট টেকনোলজি ভিত্তিক মিশ্র অণুজীব (মাইক্রোবিয়াল) সারের ব্যবহার তথা ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষি একটি সমাধান হতে পারে, যা মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি, উৎপাদনশীলতা ও স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে এবং পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমায়। আর তাই বেশি বেশি এ ধরনের সার উদ্ভাবন টেকনোলজি ওপর গবেষণার জন্য প্রয়োজন।
দেশে মাটির উর্বরতা শক্তি ক্রমেই কমছে। প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের ঘাটতিতে ভুগছে কৃষিজমি। বাড়ছে অনুর্বর তথা অনাবাদি হয়ে পড়া জমির পরিমাণ। সামপ্রতিক এক গবেষণার তথ্য বলছে, ২০০০ সালে দেশে উর্বরতা ঘাটতিতে থাকা জমির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১০ লাখ হেক্টর। ২০২০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১১ লাখ হেক্টরে। জমির অনুর্বরতা যেভাবে বাড়ছে, তা দেশের মাটির উর্বরতাশক্তি ক্রমাগত কমছে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের ঘাটতিতে থাকছে কৃষিজমি। বাড়ছে অনাবাদি জমির পরিমাণ। সম্প্রতি একটি গবেষণার চিত্রে দেখা যায়, ২০০০ সালে দেশে উর্বরতা বা অনাবাদি জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ হেক্টর। ২০২০ সালে বেড়ে পরিমাণ হয় ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টরে। বর্তমানে আরো অনেক বেশি। জমির অনুর্বরতা বা অনাবাদি যেভাবে বাড়ছে তা আশঙ্কাজনক। এর পেছনে অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহারকে দায়ী করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান ও গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বিজ্ঞানী ড. মো. লতিফুল বারীসহ অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষক। সুতরাং অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ পরিবেশ নিয়ে কাজ করার অর্গানাইজেশনগুলোর সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে ।
পরিবেশ ও জলবায়ু উপর ইতিবাচক প্রভাব-গবেষণা তথানুযায়ী, মিশ্র অণুজীব সার (মাইক্রোবিয়াল) ব্যবহারে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ইমিশন বহুগুণ কমাবে, পাশাপাশি রাসায়নিক সার ব্যবহারের প্রবণতা ৭৫-৮০% অর্থ্যাৎ বহুগুণ কমে আসে ফলে মাটি, পুকুর নদী-নালা, জলাশয়ের পানি এবং পরিবেশ দূষণ বহুগুণ কমে আসে। এর ফলে জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়, যা আরো স্থিতিস্থাপক এবং সুষম বাস্তুতন্ত্রে অবদান রাখে।
ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে অণুজীব সার ব্যবহার করলে মাটির স্বাস্থ্য বা উর্বরতা শক্তি ফিরে পায় ফলে ফসল উৎপাদন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেই ক্রমবর্ধমান বাড়তি জনগোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত খাদ্য চাহিদা মেটাবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। অণুজীব সার পুষ্টির প্রাপ্যতা এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি উন্নত করে ফসলের উৎপাদন ২০-৩০% বৃদ্ধি করতে পারে। এগুললো পুষ্টির শোষণ বৃদ্ধি করে, যার ফলে উদ্ভিদ সুস্থ থাকে এবং উন্নতমানের ফসল উৎপাদন করে বলে গবেষণা হতে জানা যায়।
অণুজীব সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সার ব্যবহার বহুগুণ কমে যায়। অর্থ্যাৎ, ৭৫% কম হয় এবং জমিতে ফসল উৎপাদন আগের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। ফলে কৃষকের ফসল উৎপাদন খরচ কমবে এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে। এ সার ব্যবহারে মাটির স্বাস্থ্য বৃদ্ধি বা উর্বরতা বৃদ্ধি হয়, ফলে কৃষকের বহু অনাবাদি বা পতিত জমিতে কৃষক পুনরায় ফসল ফলাতে পারবে, সুতরাং কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে।
নারী কৃষকেরা যেভাবে উপকৃত হবেন—অনুজীব সার খুব সহজে নারী কৃষকেরা তাদের বাসাবাড়িতে বানাতে পারবে কারণ অনুজীবগুলো বাড়ির আঙিনার পচা ময়লা গোবর, মাটি বা জৈব সারের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করতে হয়, যা নারী কৃষকদের জন্য খুবই সহজ হবে এবং এর ফলে নারী উদ্যোক্তা তৈরি হবে।
দেশীয় প্রযুক্তির সার উদ্ভাবন সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব-মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে। ফলে কৃষি অর্থনীতির ইতিবাচক প্রভাব হবে। দীর্ঘদিনের পতিত বা অনাবাদি জমিগুলো প্রাণ ফিরে পাবে, ফসল উৎপাদন বাড়বে এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, নতুন উদ্যোক্তা বা কৃষি শিল্প তৈরি হবে, অনেক বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে। দেশীয় নিজস্ব প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব সার শিল্প তৈরি হবে, ফলে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে।
সুতরাং আমার মতে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ক্লাইমেট স্মার্ট টেকনোলজিভিত্তিক মিশ্র অণুজীব সার প্রযুক্তি উদ্ভাবন ব্যবহার গবেষণাটি পাইলটিং পর্যায়ে অর্থ্যাৎ, বড় পরিসরে করার সময় এখনই। এ জন্য সরকারের তরফ কোনো প্রকল্প গ্রহণ করাসহ উৎসাহ ও সহযোগিতা উচিত।
আমি মনে করি সরকার এ ধরনের উদ্যোগ নিলে বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতা করলে দেশীয় প্রযুক্তির পরিবেশবান্ধব জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ক্লাইমেট স্মার্ট অণুজীব (মাইক্রোবিয়াল) সার শিল্পের দ্বার উন্মোচন হবে, নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে । (প্রকাশ- কালেরকন্ঠ)
লেখক ও গবেষক
সর্দার এম জাহাঙ্গীর হোসেন
সাবেক সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক (চায়না)
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি
