.jpg)
সম্প্রতি খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে ফুলকপি চাষিদের দুর্দশার কথা। অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে বাজারে ফুলকপির দাম এতটাই কমে গেছে যে অনেক কৃষক তা পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, এমনকি বিক্রি না করতে পেরে ফেলে দিচ্ছেন। অর্থনীতির সাধারণ সূত্র বলে, চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেড়ে গেলে মূল্য কমে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে কৃষকদের যুগে যুগে ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণ শুধু অতিরিক্ত উৎপাদন নয়। বরং এর পেছনে রয়েছে বাজার ব্যবস্থার ত্রুটি, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং যথাযথ বিপণন ব্যবস্থার অভাব।
একদিকে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পান না, অন্যদিকে সাধারণ ভোক্তারা উচ্চমূল্যে খাবার কিনতে বাধ্য হন। অথচ আমাদের দেশে এখনও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। ইউরোপিয়ান কমিশনের এক গবেষণা অনুযায়ী, এখনো দেশের ২৬ শতাংশ মানুষ (যার মধ্যে তিন লাখ রোহিঙ্গাও অন্তর্ভুক্ত) চরম খাদ্য অনিরাপত্তায় ভুগছে। তাহলে সমস্যার মূল কোথায়?
সমাধান হতে পারে সার্কুলার কৃষি প্ল্যাটফর্ম
এই সংকট মোকাবিলার জন্য গবেষকরা ‘সার্কুলার কৃষি উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্ম’ গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছেন। এই ধারণাটি এসেছে ‘সার্কুলার ইকোনমি’ বা বৃত্তাকার অর্থনীতির ধারণা থেকে, যেখানে বর্জ্য হ্রাস, পুনর্ব্যবহার এবং টেকসই কৃষিপ্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে অনেকটা স্বভাবতই সার্কুলার কৃষি চর্চা করে আসছিল। যেমন, গরুর গোবর জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, ধানের তুষ ছাই থেকে শক্তি উৎপাদিত হয় ইত্যাদি। কিন্তু আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির দৌলতে এখন অনেক কৃষক নন-অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছেন, যা খাদ্যে বিষক্রিয়া বাড়িয়ে তুলছে।
কেমন হবে সার্কুলার কৃষি প্ল্যাটফর্ম?
এই প্ল্যাটফর্মটি দুটি প্রধান অংশে কাজ করবে:
১. ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম (অ্যাপ ও ওয়েবসাইট)
- কৃষকরা সরাসরি তাদের উৎপাদিত পণ্যের তথ্য ও মূল্য অ্যাপে আপলোড করতে পারবেন।
- ভোক্তারা অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য কিনতে পারবেন।
- উদ্যোক্তারা কৃষিপণ্য বাজার সম্পর্কে আগেভাগে জানতে পারবেন এবং বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবেন।
২. ভৌত প্ল্যাটফর্ম (সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কেন্দ্র)
- উপজেলা পর্যায়ে স্টোরেজ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
- কৃষকরা সেখানে তাদের উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ করতে পারবেন, যাতে মৌসুম শেষে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করা যায়।
- খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ সুবিধা থাকলে অতিরিক্ত ফসল নষ্ট হবে না এবং বাজারে মূল্য স্থিতিশীল থাকবে।
- কৃষকদের মালিকানাধীন এই কেন্দ্র তাদের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়াবে, ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমবে।
এই প্ল্যাটফর্মের সম্ভাব্য সুবিধা
- কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবেন।
- ভোক্তারা মানসম্পন্ন খাবার যুক্তিসঙ্গত দামে কিনতে পারবেন।
- খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশ ঘটবে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
- খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে বড় কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য কমবে।
- স্থানীয় উৎপাদন ও বিক্রয় বাড়ায় কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পাবে।
বাস্তবায়নের উপায়
প্রাথমিকভাবে, এটি একটি উপজেলার কিছু গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করা যেতে পারে। সফল হলে এটি জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে সম্প্রসারিত করা সম্ভব। প্ল্যাটফর্মটি পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হবে:
- আইটি বিশেষজ্ঞ: অ্যাপ ও ওয়েবসাইট পরিচালনার জন্য।
- স্টোরেজ ও প্রসেসিং ম্যানেজার: কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাপনার জন্য।
- উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী: নতুন কৃষিভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠার জন্য।
- গবেষক ও প্রশিক্ষক: কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও নতুন উদ্ভাবন বাস্তবায়নের জন্য।
কৃষকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সমাধান
এই প্ল্যাটফর্ম শুধু কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করবে না, বরং এটি একটি সার্বিক টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। সরকার, গবেষণা সংস্থা এবং এনজিওদের সহায়তায় এটি একটি শক্তিশালী কৃষি ইকোসিস্টেম তৈরি করতে পারে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সবুজ সার, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারেন।
বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য এই ধরনের একটি ব্যবস্থা প্রয়োজন, যাতে তারা আর ফসল মাঠে ফেলে দিতে বাধ্য না হন এবং ভোক্তারাও যুক্তিসঙ্গত মূল্যে নিরাপদ খাদ্য পান।
- লেখক, সিনিয়র প্রভাষক, ইউনিভার্সিটি ওয়েস্ট, সুইডেন, স্টারস ইইউ প্রভাষক
- যোগাযোগ: sabrina.luthfa@hv.se / Luthfasabrina1611@gmail.com