www.agribarta.com:: কৃষকের চোখে বাংলাদেশ
শিরোনাম:

জামাই সোহাগী, রূপকথা সাদাকানি রক্ষার লড়াই


 এগ্রিবার্তা ডেস্ক    ১২ ডিসেম্বর ২০২২, সোমবার, ৭:৫৩   কৃষি গবেষণা বিভাগ


ধানের নাম জামাই সোহাগী। পায়েস, পিঠা ও পোলাওয়ের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। আরেক জাতের নাম নীলকণ্ঠ। এর চিকন চাল পান্তাভাতের জন্য খুবই ভালো। আবার সুঘ্রাণের জন্য একটি জাতের নামই পড়েছে রাঁধুনিপাগল। আরেক জাতের নাম রূপকথা। তারও আছে সুগন্ধ। একসময়ের ঐতিহ্যবাহী এসব ধান কৃষকের হাত থেকে হারাতে বসেছে। এমন ৭০ জাতের ধান এবার নিজের এক প্লটে চাষ করেছেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের কৃষক জাহিদুর রহমান। তিনি বিলুপ্তির হাত থেকে এদের রক্ষা করতে চান। জাহিদুর রহমানের ভাই ইউসুফ মোল্লা ছিলেন বিলুপ্তপ্রায় এই ধানের সংগ্রাহক। তাঁর সংগ্রহে ছিল ৩১০ জাতের ধানের বীজ। গত ১৪ জানুয়ারি তিনি মারা গেছেন। ছোট ভাই জাহিদুর রহমান তাঁর স্মৃতি রক্ষায় ধানবীজগুলোকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি ভাইয়ের সংগ্রহশালা থেকে ৭০ জাতের ধানবীজ নিয়ে চাষ করেছেন। গত ২৪ নভেম্বর তিনি সেই ধান মাড়াই করেছেন। ইউসুফ মোল্লা ২০১৩ সালে বিলুপ্তপ্রায় ধান সংরক্ষণের জন্য পেয়েছিলেন পরিবেশ পদক। তিনি তাঁর বীজের সংগ্রহশালার নাম দিয়েছিলেন ‘বরেন্দ্র কৃষিবীজ ব্যাংক’। তিনি সারা দেশের আগ্রহী কৃষকদের দুবইল গ্রামে নিয়ে এসে বীজ বিনিময় উৎসব করতেন। একই দিনে করতেন নবান্ন উৎসবের আয়োজন। তাঁর সংগৃহীত ৩১০ জাতের ধানের বীজের মধ্যে জীবিত বীজ রয়েছে ২০৫টি।

চাষ না করলে একসময় বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ জন্য ছোট ভাই জাহিদুর রহমান ভাইয়ের ভান্ডারের বীজগুলো জীবিত রাখার জন্য এবার দুবইল মাঠে ৩৮ শতক জমিতে ৭০ জাতের ধান রোপণ করেছিলেন। তাঁর এই কাজে সহযোগিতা করছে বেসরকারি সংস্থা ‘বারসিক’।

এবারের রোপণ করা ৭০ জাতের ধানগুলো হচ্ছে রাঁধুনিপাগল, বাসমতি, নারীপারিজাত, কাটারিভোগ, কালিকুজি, সাদা আশকল, বাগুনশাইল, চিনিসংকর, কালিকুঠি, রূপকথা, লতিফশাইল, সিন্দুরকাঠি, রানীস্যালট, মহেশ্বর, সাদাকানি, লাল বাজাল, ভজন, বাইনাচিকন, রাইতল, ছোট কালোজিরা, কালোজিরা (নড়াইল অঞ্চল), সুলি, মহিপাল, মুগাইবেতি, চেংগুর, সাদা টেপা, দেশি আতপ, গাঞ্জিয়া, হলুদবাটা, ডিবি, মালতি, নিরিকা, নীলকণ্ঠ, জটা বাঁশফুল, ঘুরন, মালা, গোছা, বালাম, মধুমাধব, আমন, গোবিন্দভোগ, জামাইসোহাগী, সুবাই, যুবরাজ, কাজললতা, রানারশাইল, বাদশাভোগ, বাতরাজ, খিরকন, আসকল, মহিপাল, নাজিরশাইল, সাদা টেপা, সাদা কথা, কৃষ্ণকলি, উরিশাইল, রতি, মহিষ বাথান, কালিটেপি, নয়ন কলমা, কালোবিন্নি, হলুদ ডেপা, মুগাশাইল, জোসনা, লাইটা বোর, গচি, মাটিয়া গরল, খাইনল ও ময়রোম।

ধান রোপণের পর জাত চিহ্নিতকরণের জন্য সাইনবোর্ড দেওয়া হয়েছিল। জাহিদুর রহমান জানান, গত ১৬ জুলাই তিনি বীজতলায় ধান ফেলেছিলেন। ৭০ জাতের ধানেরই চারা গজায়। ১০ আগস্ট তিনি চারা রোপণ করেন।

রাজশাহী শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরের নিভৃত গ্রাম দুবইল। গত ২১ নভেম্বর বিকেলে এই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রূপকথা বাদ দিয়ে সব ধান কেটে জমিতেই শুকাতে দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, দুই-তিন দিনের মধ্যেই ধান মাড়াই করেন। জাহিদুর রহমান জানান, বীজ জমিতে ফেলা থেকে শুরু করে মাড়াই করে আবার বীজে পরিণত করা পর্যন্ত প্রায় ১৪০ দিন সময় লাগে।

জাহিদুর জানান, রূপকথা আর কৃষ্ণকলি ধানমাড়াইয়ের পর ওজন করা হয়েছে। বিঘায় রূপকথার ফলন হয়েছে ১২ মণ। আতপ চালের মতো এর ঘ্রাণ আছে, চাল চিকন। এই চাল দিয়ে পোলাও করা যায়, আবার ভাতও করা যায়।

কৃষ্ণকলির ফলন পেয়েছেন বিঘাপ্রতি ১০ মণ। এই ধানেরও চাল মোটামুটি চিকন। চালে হালকা ঘ্রাণ আছে। ভাত-পোলাও দুটোই এই চাল দিয়ে করা যায়। জামাইসোহাগী ধানও সুগন্ধি। পোলাও, পায়েস, পিঠা খাওয়ার জন্য এই ধানের চাল খুবই ভালো। বাগুনশাইলও সুগন্ধি। এর চাল ছোট ও চিকন। পিঠা-পুলি–পায়েস খাওয়ার জন্য ভালো। নীলকণ্ঠও একটি চিকন ধান। পান্তাভাত করার জন্য এই ধান বেশ ভালো।

জাহিদুর বলেন, যে ধানগুলো চাষ করেছেন, এগুলো সবই বাংলাদেশের একেকটি ঐতিহ্যবাহী ধান। এই ধান কৃষকদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল। তাঁর ভাই সারা দেশে ঘুরে ঘুরে কৃষকের বাড়ি থেকে এই ধানের জাত উদ্ধার করেছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই ধান যাতে হারিয়ে না যায়, সেই জন্য তিনি চাষের মাধ্যমে এই ধানের বীজ বাঁচিয়ে রাখবেন। এর মাধ্যমে ভাইয়ের স্মৃতিও রক্ষা পাবে। তিনি বলেন, ভাইয়ের স্লোগান ছিল ‘স্থানীয় বীজ রক্ষা করি, কৃষির ভিত মজবুত করি’। ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও প্রতিবছর নবান্ন উৎসবের আয়োজন করবেন।

হেরিটেজ রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা গবেষক মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, ১৫ বছর ধরে তিনি বিলুপ্ত ধানের সংগ্রাহক ইউসুফ মোল্লার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। কয়েক বছর তিনি তাঁর নবান্ন উৎসবে সভাপতিত্ব করেছেন। তিনি বলেন, আগে বনেদি পরিবারে বিশেষ ধানের চাল রান্না হতো।

তাঁরা ওই বিশেষ ধান ছাড়া অন্য ধানের ভাত খেতেন না। তিনি দেখেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছাইরা বেগম নামের একজন নারী সারা জীবন শুধুই রাঁধুনিপাগল আর জটাবাঁশ ফুল ধানের ভাত খেয়েছেন। শেষ জীবনে যখন এই ধান বাজারে পেতেন না, তখন নিজের খাওয়ার জন্যই এই ধান চাষ করেছেন। ২০০৬ সালে তিনি মারা গেছেন।

মৃত্যুর আগপর্যন্ত অন্য কোনো ধানের ভাত খাননি। ইউসুফ মোল্লার ছোট ভাই জাহিদুর রহমান এই ধানের বীজের প্রাণ বাঁচিয়ে রাখার জন্য চাষ করছেন। রাজশাহীর তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহম্মদ বলেন, ইউসুফ মোল্লা যেভাবে ধানবীজ সংরক্ষণ করেন, এটা খুবই ব্যয়বহুল।

বারবার চাষ করে ধানবীজকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, যে কাজ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রযুক্তির মাধ্যমে করে। ইউসুফ মোল্লার ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। এটা কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি চেষ্টা করবেন।

 




  এ বিভাগের অন্যান্য